ছেলে আর জামাই সময় মতো উদ্ধার না করলে আমার কী যে হত জানিনা। নিরাপত্তা রক্ষীদের নিষেধাজ্ঞা না শুনে ওরা নীচের তলা থেকে চার তলায় এসে আমাকে বিছানা থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়। নার্সরা বাধা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সামান্য আগুন লেগেছে। কিন্তু ওয়ার্ডের দরজা খুলতেই ঝাঁঝালো ধোঁয়া আমাদের যেন গিলে ফেললো। তখনই বুঝেছিলাম ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে দিয়েছে। হঠাৎ চারপাশের আলোগুলো নিভে গেল। ছেলের হাত শক্ত করে ধরে লিফটের কাছে গিয়ে দেখি, লিফট বন্ধ। দেওয়াল হাতড়ে কোনওরকমে সিঁড়ির কাছে পৌঁছই। সিঁড়ি বেয়ে আমরা নীচে নামতে থাকি। চারদিকে সাহায্য চেয়ে চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। পাশ দিয়ে আমাদের মতো অনেকেই সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। সব মিলিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা। যত নীচে নামছি, ধোঁয়া তত ঘন হচ্ছিল, গন্ধও তত ঝাঁঝালো হচ্ছিল। সকলেরই রীতিমতো শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, বোধহয় আর বেঁচে বের হতে পারব না।
এর মধ্যেই দেওয়াল হাতড়ে, অন্য লোকেদের ধাক্কা খেতে খেতে কোনও রকমে হাসপাতালের নীচের তলায় নামলাম। দেখি প্রচুর লোকজন উদ্ভ্রান্তের মতো এ দিক-ওদিক দৌড়দৌড়ি করছেন। নীচের তলা একটাই ধোঁয়া ছিল যে শ্বাস নিতে গিয়ে হাঁফ ধরে যাচ্ছিল। ছেলে বিজয় ও জামাই পতিত কার্যত আমাকে তুলে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে আসে। বাইরে খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার পরে মনে হল যেন পুর্নজন্ম হল। তখন প্রায় ভোর প্রায় চারটে বাজে। অন্ধকার কাটেনি। ওরা আমাকে মাটিতে বসিয়ে দেয়। ঘোর কাটতেই বেশ কিছুটা সময় লাগল।
কিছু ক্ষণ পরে প্রথমে পুলিশের গাড়ি আসতে দেখি। তারও কিছুটা পরে দমকলের অনেকগুলি গাড়ি পর পর হাসপাতাল চত্বরে ঢুকল। আশপাশের লোকজনের মুখে শুনতে পাই ভিতরে বিরাট আগুন লেগেছে। অনেক রোগীই মারা গিয়েছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে ভগবানকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলাম। বার বার মনে পড়ছিল আমার ওয়ার্ডে ঘুমিয়ে থাকা বাকিদের কী হল? তাঁরা কী নামতে পেরেছিলেন? শেষ মুহূর্তে কী কাউকে উদ্ধার করা গিয়েছিল। জানার উপায় ছিল না। ভাবছিলাম, ভাগ্যিস ছেলে-জামাই সঙ্গে ছিল!
বছর তিনেক আগে ঢাকুরিয়ার এই হাসপাতালে আমার বুকে বেসমেকার বসানো হয়েছিল। তার পরে মাঝেমধ্যেই ‘চেকআপের’ জন্য এখানে এসেছি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ছেলে ও তিন জামাইয়ের সঙ্গে এসেছিলাম। চিকিৎসক দেখার পরে কয়েকটি পরীক্ষা করার জন্য আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। সন্ধ্যা সাতটায় চার তলার ওয়ার্ডে উঠে দেখি ছ-সাত জন রোগী রয়েছেন। আমার বেড নম্বর ছিল ২৩৪০। ছেলে ও জামাইরা নিরাপত্তারক্ষীদের অনুরোধ করে নীচের তলায় নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করে। গভীর রাতে নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আগুন লাগার খবর পেয়ে আর ঘুম আসেনি। হঠাৎ ছেলে আর জামাই আগুন লেগেছে বলে আমার কাছে দৌড়ে আসে। ৫৬ বছর বয়েসে বুকে ব্যাথা নিয়ে কী করে যে এতগুলো সিঁড়ি ভেঙে নামলাম ভেবে পাচ্ছি না।
সময় যত গড়িয়েছে, পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, দমকল, এলাকার লোক জনের ভিড় হাসপাতাল চত্বরে বাড়ছিল। তাঁদের কথাবার্তায় বুঝতে পারি বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। অনেক রোগী মারা গিয়েছেন। আত্মীয় ও সহকর্মীদের ফোন করে জানাই, খুব জোর বেঁচে গিয়েছি। আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা খুব দরকার ছিল। কিন্তু চোখের সামনে যা দেখলাম তার পরে বাড়ির বাইরে থাকতে আর এক মুর্হূতও ইচ্ছা করছিল না। ছেলে ও জামাইদের সঙ্গে পরামর্শ করে সাঁওতালডিহির বগড়ায় বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিই। সকাল আটটায় হাসপাতালের সামনে থেকে হাওড়া স্টেশনের বাস ধরি। পিছন ফিরে দেখি, কালো ধোঁয়ায় হাসপাতাল ঢেকে গিয়েছে। আবার কপালে হাত ঠেকাই। |