ফেরার অপেক্ষায় থেকেই ছুটি চিরতরে
‘ছুটি’ পেয়ে এক জনের আজ, শুক্রবারই ফেরার কথা ছিল বাড়িতে। আর এক জনের কাল, শনিবার। নভেম্বরের শেষে অসুস্থতা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার ঢাকুরিয়ায় ‘আমরি’ হাসপাতালে। দু’জনেই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তাই হাসপাতাল থেকে ‘ছুটি’র দিনও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। শুক্রবারের কাকভোর অভাবিত বিপর্যয় নিয়ে এল চন্দ্রকোনা ও কোলাঘাটের দু’টি পরিবারে। চিরতরেই ছুটি হয়ে গেল চন্দ্রকোনার পুষ্প দাসের। খোঁজ মিলছে না কোলাঘাটের পঞ্চানন মাইতির।
পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনার জাড়া গ্রামের বছর ষাটের পুষ্পদেবী গলব্লাডারের স্টোন-জনিত সমস্যায় অস্ত্রোপচারের জন্য ঢাকুরিয়ার ওই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন গত ২৮ নভেম্বর। ৩০ তারিখ ‘সফল’ অস্ত্রোপচারও হয়। আর পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মী, বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশের মেসেড়া গ্রামের বছর আটান্নর পঞ্চাননবাবু মূত্রনালির সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন ২৯ তারিখে। পাশাপাশি দুই জেলার এই দুই বৃদ্ধা-বৃদ্ধ ভর্তিও ছিলেন বেসরকারি ওই হাসপাতালের প্রায় পাশাপাশি দু’টি ঘরে, চার তলার ২৩১৯ ও ২৩১৪ নম্বরে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ‘ভিজিটিং আওয়ার’-এ বাড়ির লোক যথারীতি দেখা করেছিলেন। দু’জনেই বাড়ি ফেরার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। ফিরে কী, কী করবেন সে নিয়েও কথা বলেছিলেন ছেলে, ছেলের বৌয়ের সঙ্গে।
নাতনিকে কোলে নিয়ে বাদলবাবু। জাড়ার বাড়িতে। —নিজস্ব চিত্র।
হাসপাতালের সেদ্ধ খাবার আর মুখে রুচছিল না পুষ্পদেবীর। বাড়ি ফিরেই জিওল মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাবেন বলেছিলেন ছেলেদের। সে কথা ফোনে ওই সন্ধ্যায় চন্দ্রকোনার বাড়িতে অশীতিপর বাবা বাদলবাবুকে জানিয়েও ছিলেন বড়ছেলে বিশ্বনাথ, ছোটছেলে জয়দেব। হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে শনিবারই স্ত্রী ফিরছেন, এ কথা জেনে শিশুর মতোই খুশি হয়ে উঠেছিলেন বৃদ্ধ বাদলবাবু। সাত তাড়াতাড়ি ওই রাতেই মাগুর মাছ কিনে এনে জ্বালায় জল দিয়ে রেখেছিলেন।
মা-কে ভর্তি করা থেকেই ঢাকুরিয়াতেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে ছিলেন বিশ্বনাথ ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী। জয়দেবও বৃহস্পতিবার মা-কে দেখে থেকে গিয়েছিলেন দাদা-বৌদির সঙ্গে সেই অস্থায়ী আস্তানায়। শুক্রবার ফিরে শনিবার সকালে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে ফের ঢাকুরিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল জয়দেবের। কিন্তু শুক্রবার কাকভোরেই জানতে পারেন ‘আমরি’তে আগুন লেগেছে। বিশ্বনাথ-জয়দেবরা ছুটে যান। কিন্তু ওই হাসপাতালের কর্মী, নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের ঢুকতে দেননি বলে অভিযোগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী বিশ্বনাথবাবু, স্কুলকর্মী জয়দেবের। “ঢুকতে দিলে আমরা দু’ভাই মিলে মা-কে নিয়ে ঠিক বেরিয়ে আসতাম। ওরা যেতে দিল না। চোখের সামনে দেখলাম গোটা হাসপাতাল বাড়িটা ধোঁয়ায় ঢেকে যেতে। একটু বেলা হতেই জানলামমা আর নেই”, সন্ধ্যায় কলকাতা থেকে মৃতদেহ নিয়ে চন্দ্রকোনা রওনা হওয়ার মুখে ফোনে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন বিশ্বনাথ। সকালে ফোনেই খবর এসেছিল জাড়ার বাড়িতে। কান্নার রোল সেখানেও। বাদলবাবু প্রায় বাগরুদ্ধ।
পঞ্চাননবাবুর ভাইপো দেবব্রত, যাঁকে নিঃসন্তান পঞ্চাননবাবু ও তাঁর স্ত্রী আরতিদেবী ছেলের মতোই বড় করেছেন, সকাল থেকে হাসপাতালের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেও রাত ন’টা পর্যন্ত জানতেই পারেননি ঠিক কী পরিণতি হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃতের যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে নাম নেই পঞ্চাননবাবুর। এক বার এসএসকেএম হাসপাতালের মর্গে গিয়েও মৃতের তালিকা, এমনকী মৃতদেহগুলি দেখে এসেছেন। কিন্তু সেখানেও কিছু হদিস পাননি দেবব্রত। দিনভর মৃত্যু-মিছিল দেখতে দেখতে বিধ্বস্ত তিনি। রাতেও ‘আমরি’র সামনে দাঁড়িয়েই ফোনে দেবব্রত বলেন, “কাল (বৃহস্পতিবার) সন্ধেবেলা দেখা করে কোলাঘাটে ফিরেছিলাম। আজ (শুক্রবার) সকালে গাড়ি নিয়ে বাবাকে (এই সম্বোধনেই অভ্যস্ত) আনতে যাওয়ার কথা ছিল। ভোরেই আগুন লাগার খবর পাই। পড়িমরি করে পৌঁছই। আগে তিন-তিন বার এই হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু এ বার কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল!” মাইতি ও দাস পরিবারের সদস্যরা বলছেন, “বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়েই চরম বিপদ ঘটেছে।” কেন্দ্রীয় শীততাপ ব্যবস্থায় হাসপাতালের বদ্ধ কাচের ঘর সত্যিকারেই যে হয়ে উঠেছিল জতুগৃহ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.