আফশোসটা কিছুতেই যাচ্ছে না বিক্রম সাউ আর বিপিন গনোত্রার। এক জন দমকলের ফায়ার অপারেটর। অন্য জন বহু বছর ধরে দমকলের স্বেচ্ছাসঙ্গী। দু’জনেরই আফশোস, ‘‘আর একটু আগে খবর পেলে আরও কয়েক জনকে বাঁচানো যেত।’’
দমকলের সদর দফতরে ‘এ’ ডিভিশনের কর্মী বিক্রম। শুক্রবার এএমআরআই-এ আগুন লাগার খবর পাওয়ার পরে যে দলটি প্রথমে সেখানে পৌঁছয়, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। মৃত্যুর পরোয়া না-করে বিক্রম মই নিয়ে সটান উঠে গিয়েছিলেন হাসপাতালের বিষাক্ত ধোঁয়ায় ঢাকা চারতলায়। পাঁজাকোলা করে কিংবা কাঁধে নিয়ে একে একে ১৪-১৫ জনকে জানলা দিয়ে বার করে উদ্ধার করার পরে বিষাক্ত গ্যাসে অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারান তিনি। পরে হাসপাতালের মেন বিল্ডিংয়ের তিনতলার ডায়ালিসিস ইউনিটের আইটিইউ-তে শুয়ে বিক্রম বলছিলেন, “হাসপাতাল চত্বরে ঢুকেই বুঝতে পারি, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রথমে সামনের গেট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ধোঁয়ার ধাক্কায় বেরিয়ে আসি। তখনও আমাদের মুখোশ এসে পৌঁছয়নি। মই দিয়ে দ্রুত চারতলায় উঠে জানলার কাচ ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ি। ততক্ষণে অন্যরাও এসে গিয়েছেন। আমি এক-এক জনকে কাঁধে করে বা কোলে করে নীচে পাঠাচ্ছিলাম। বাকিরা উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ ভাবে ১৪-১৫ জনকে উদ্ধার করেছি। তার পরে আর কিছু মনে নেই।” প্রায় দু’ঘণ্টা একটানা লড়াই চালানোর পরে অসুস্থ হয়ে পড়েন বছর পঁয়ত্রিশের বিক্রম। |
অসুস্থ হয়ে পড়া এক দমকলকর্মীর শুশ্রূষা। শুক্রবার। ছবি: পিন্টু মণ্ডল |
ছেলের অসুস্থতার খবর পেয়ে সকাল সাড়ে সাতটায় আর এক ছেলে রূপমকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছন বাবা নিশিকান্ত সাউ। পিকনিক গার্ডেনের বাসিন্দা নিশিকান্ত বলছিলেন, “ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা ডাকাবুকো। কেউ বিপদে পড়লে সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।” ভাইদের মধ্যে এখন বিক্রমই একমাত্র রোজগেরে। কিন্তু আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়ে এ সব কথা মনে আসে না তাঁর। গত বছর স্টিফেন কোর্টের ভয়াবহ আগুন লাগার দিনে ‘ডিউটি’ না থাকার আফশোস এখনও রয়েছে। পরে অবশ্য গিয়েছিলেন সেখানে।
স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডের দিনেও অবশ্য দমকলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদ্ধারকাজ চালিয়েছিলেন বিপিন গনোত্রা। গত চল্লিশ বছর ধরেই শহরে কোথাও বড়সড় আগুন লাগার ঘটনা ঘটলে সেখানে হাজির হয়ে যান তিনি। শুক্রবার সকালেও অগ্নিকাণ্ডের খবর শুনে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এসেছিলেন ঘটনাস্থলে। দমকলকর্মী এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে রোগীদের উদ্ধারের কাজে হাত লাগিয়েছেন। কিন্তু একরাশ আফশোস বিপিনের চোখমুখেও। তিনি জানান, এ দিনের আগুন স্টিফেন কোর্টের ভয়াবহতাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। স্টিফেন কোর্টে সাধারণ মানুষ ঢুকে পড়ায় অনেককেই বাঁচানো গিয়েছিল। এই হাসপাতালের ঘটনায় তা সম্ভব হয়নি। তাঁর কথায়, “হাসপাতাল দেরিতে খবর দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদেরও প্রথমে ঢুকতে দেয়নি।” এর পরেই হতাশ গলায় বিপিন বলেন, “সামান্য ভুলও কী ভাবে অনেকের ঘর খালি করে দিতে পারে, আজকের ঘটনা তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আমরা কিছুই করতে পারলাম না।” |