চিন্তা করবেন না, বিমানের হাত ধরে আশ্বাস মমতার
জিরবিহীন ট্র্যাজেডি বেনজির ঐক্য এনে দিল রাজ্যের দুই যুযুধান রাজনৈতিক শিবিরে। ‘সহমর্মিতা’র ঐক্য। আর্ত, ভাগ্য বিড়ম্বিতদের ‘পাশে দাঁড়ানো’র ঐক্য।
যে ঐক্যের ফ্রেমে ধরা পড়ল, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর হাত ধরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্বাস দিচ্ছেন চিন্তা করবেন না।
যে ঐক্যের ছবিতে উঠে এল, মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এক বার ঢাকুরিয়ার এএমআরআই হাসপাতাল, আর এক বার এসএসকেএম হাসপাতালের মর্গের বাইরে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। মুখ্যমন্ত্রীকে প্রস্তাব দিচ্ছেন, এমন মর্মান্তিক ঘটনার পরে রাজ্য সরকার আজ, শনিবার শোক দিবস ঘোষণা করুক। আশ্বাস দিচ্ছেন সরকারের সঙ্গে বিরোধীদের ‘সর্বাত্মক সহযোগিতার’।
টুকরো টুকরো ঘটনার মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য নিঃসন্দেহে শুক্রবার মমতা-বিমানের মুখোমুখি সাক্ষাৎ। রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূল নেত্রী এবং সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকের ‘সম্পর্ক’ কোনও বিশেষণে বাঁধা পড়ার অবকাশ রাখে না। বস্তুত, কোনও ‘সম্পর্ক’ই নেই দু’জনের। কিন্তু বাক্রুদ্ধ করে দেওয়ার মতো দুর্ঘটনার দিনে তাঁরা দু’জনেই সেই রাজনৈতিক ‘অস্পৃশ্যতা’ মনে রাখেননি। এগিয়ে গিয়েছেন পরস্পরের দিকে। ভাগ করে নিয়েছেন দুর্ঘটনা সংক্রান্ত তথ্য।
এসএসকেএমে বিমান বসু ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি স্টার আনন্দের সৌজন্যে।
সকালেই এএমআরআই-তে পৌঁছেছিলেন বিরোধী দলনেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যবাবু। দুপুরে গিয়েছিলেন এসএসকেএমে। দু’বারই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়। বিকালে বিমানবাবু আর এএমআরআই-র দিকে যাননি। মরদেহগুলি যে হেতু এসএসকেএমে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হচ্ছিল। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান হিসাবে বিমানবাবু তিন শরিক নেতা মঞ্জুকুমার মজুমদার, মনোজ ভট্টাচার্য এবং হাফিজ আলম সৈরানিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে। মর্গের সামনে তাঁদের হাতের কাছে পেয়ে মৃতদের আত্মীয়স্বজন বলেন, ময়নাতদন্তের পরে দেহগুলি নিয়ে ফিরে যাওয়ার কোনও ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। বিমানবাবু তাঁদের বলেন, সরকার সব রকম চেষ্টা করছে। তাঁদের একটু ‘ধৈর্য’ ধরতে হবে। উদ্বিগ্ন জনতা ক্ষোভপ্রকাশ করে বলে, ‘রাজনীতিকদের মতো কথা’ বলছেন কেন? বিমানবাবু কিন্তু পাল্টা ক্ষুব্ধ হননি। তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘রাজনীতি করতে’ কেউ ওখানে যায়নি। এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, সরকারকে একটু সময় দিতে হবে।
মর্গ থেকে বেরিয়ে উডবার্ন ওয়ার্ডের দিকে ফিরছিলেন বিমানবাবু। গাড়িতে ওঠার সময়ে পুলিশি তৎপরতা দেখে তাঁর মনে হয়, সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রী আসছেন। দুই শরিক নেতা তাঁকে বলেন, এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য একটু অপেক্ষা করে যাওয়া উচিত। বিমানবাবু মমতার মুখোমুখি হলে আবার কী ঘটে যায়, এই ভেবে এক শরিক নেতা অবশ্য ঈষৎ ইতস্তত করছিলেন। বিমানবাবু কিন্তু দ্বিধা করেননি। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রীর আসার পথের দিকে। মুখ্যমন্ত্রীও তাঁদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন। কুশল বিনিময়ের পরে বিমানবাবু মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, মৃতদের আত্মীয়দের কাছে তাঁরা কী শুনেছেন। সরকার যে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে, তার জন্য মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েই বিমানবাবু আবেদন জানান, দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষগুলির অসহায়তার কথা যেন মাথায় রাখা হয়। জবাবে মুখ্যমন্ত্রী মৌখিক আশ্বাস তো দেনই। বিমানবাবুর হাত ছুঁয়ে বলেন, সরকার সব সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি নিজে হাসপাতালে তদারকি করছেন। প্রতিপক্ষ দলের রাজ্য শীর্ষ নেতার প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস, ভাববেন না।
সব ব্যবস্থা হবে।
মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে এসএসকেএম ছাড়েন বিমানবাবুরা। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য রাত পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। বাতিল করে দিয়েছিলেন রাজারহাটে সরকারি অনুষ্ঠান। একের পর এক মৃতদেহের ময়না তদন্ত হয়েছে, কারও দেহ পিস হেভ্নে রাখতে হয়েছে, ভিন্ রাজ্যের তিন জন বা পড়শি বাংলাদেশের এক রোগীর মৃতদেহ উড়ানে ফেরত পাঠানোর বন্দোবস্ত করতে হয়েছে সবই নিজ উদ্যোগে তদারকি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এসএসকেএমেই ‘ক্যাম্প অফিস’ খুলে বসেছেন। বিভিন্ন সময়ে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করেছেন পীড়িতদের আত্মীয়-পরিজনদের উদ্দেশে।
পুলিশ, চিকিৎসক, হাসপাতালের কর্মচারী থেকে পুুরসভার কর্মী দুর্ঘটনায় যাঁরাই পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাত লাগিয়েছেন, তাঁদের সকলকে ‘ধন্যবাদ’ জানাতে সংশ্লিষ্ট কর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনাচক্রে, যে হাসপাতালেরই উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন তাঁর মা।
‘সৌজন্যে’র ছবি শুধু আমরি বা এসএসএসকেএমেই নয়, অন্যত্রও ছিল। যেমন, দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে অল্প সময়ের জন্য বিধানসভায় এসেছিলেন সেচমন্ত্রী তথা কংগ্রেস মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া। বিধানসভা চত্বরে তাঁকে দেখে এগিয়ে যান বিরোধী দলনেতা। দু’জনেই পেশায় চিকিৎসক। ঘটনার ভয়াবহতা নিয়ে দু’জনের মত বিনিময় হয়। মানসবাবু জানান, ঘটনার রিপোর্ট তিনি কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে (যাঁর কলকাতার বাড়ি আমরি-র অদূরেই) পাঠিয়েছেন।
এসএসকেএমের মর্গের সামনে বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিরোধী
দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।
এএমআরআই-এর সর্বময় কর্ণধার হিসাবে যাঁর নাম বলা হয়, সেই শ্রবণ কুমার টোডি রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে সিপিএমের ‘দুর্দিনের সঙ্গী’ এবং পরবর্তী কালের দলের সদস্যপদের অধিকারী। স্বভাবতই তাঁর হাসপাতালে এ দিনের ভয়াবহ ঘটনার সঙ্গে সিপিএম এবং বামফ্রন্ট জমানার নাম জড়িয়ে যাওয়া একেবারেই ‘অপ্রত্যাশিত’ নয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বিগত বাম জমানায় ওই হাসপাতালে বেনিয়ম প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। কিন্তু খুব ‘উচ্চকিত ভাবে’ তাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাননি, যাতে রাজনৈতিক চাপানউতোর বেধে যেতে পারে।
এএমআরআই-কাণ্ডে মৃতদের পরিবারের প্রতি ‘আন্তরিক সমবেদনা’ এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না-ঘটতে পারে, তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাও নিতে হবে’। আর প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, অধুনা বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু বলেছেন, “আমাদের রাজ্যে বা দেশে তো নয়ই, গোটা পৃথিবীতেই এমন ঘটেছে কি না, আমার জানা নেই। সমবেদনা জানানোর ভাষা নেই। চাপানউতোর-বিতর্কে যাওয়ার অবকাশ এখন নেই। কী থেকে কী হয়েছিল, সেই খুঁটিনাটিতে যাওয়ার সময়ও এটা নয়। সরকার তার কাজ করছে। আমরা সব রকম সহযোগিতা করতে তৈরি আছি।”
বাম জমানাতেই এএমআরআই-কে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। তার পুনর্নবীকরণের সময় সতর্কতা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। তারও জবাবে সূর্যবাবু শুধু বলেছেন, “যে যখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী থেকেছেন, তাঁর আমলেই কোনও না কোনও হাসপাতালকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। পুননর্বীকরণের দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট বিভাগের খতিয়ে দেখার কথা। সেটা করা হয়ে না-থাকলে তদন্তে তাদের ধরা হবে। তবে এই মুহূর্তটা এই ধরনের আলোচনার জন্য নয়।”
এসইউসি, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের মতো দলগুলি বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই দুষেছে। বিজেপি আমরি-র সবক’টি হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলের দাবি তুলেছে। আর ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমানবাবু তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন, ‘শহরের বুকে এই রকম একটি বড় হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের সকলের কাছে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অবিলম্বে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দোষীদের যথোচিত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে’।
কিছু অভিযোগ, কিছু দাবি নিশ্চয়ই থাকল। থাকবেও।
কিন্তু তাতে ম্লান হচ্ছে না মমতা-বিমানদের হাতে হাত ধরে দাঁড়ানোর ছবিটা!
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.