দশ দিন আগেই শেষ দমকলের সময়সীমা
ঢাকুরিয়ায় আমরি হাসপাতালের যে বেসমেন্টে আগুন এবং তার পর বিষাক্ত ধোঁয়ায় অসহায় মৃত্যু হল ৮৯ জনের, গত জুলাই মাসে দমকলের তরফে পরিদর্শনের পর সেই বেসমেন্ট পরিষ্কার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আমরি কর্তৃপক্ষকে শুক্রবার জানিয়েছেন কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) দময়ন্তী সেন। এ দিন দমকলের তরফে পুলিশে যে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, তাতেই এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই এফআইআরে আরও বলা হয়েছে, গত ২৯ অগস্ট বলা হয়েছিল, বেসমেন্ট পরিষ্কার করার জন্য আমরি কর্তৃপক্ষকে ৯০ দিন সময় দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, সেই সময়সীমা শেষ হয়েছে ২৯ নভেম্বর। এর মধ্যেই গত ৫ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি হলফনামায় জানান, তাঁরা ওই নির্দেশ পালন করবেন।
কিন্তু এ দিনের ঘটনা থেকে স্পষ্ট, হলফনামা দিলেও সেই নির্দেশ মানার দরকার বোধ করেননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তেমনই পরিস্থিতি আবার খতিয়ে দেখেনি দমকলও! যা প্রকাশ্যে এল ৮৯টি প্রাণের বিনিময়ে। যা এই রাজ্যে তো বটেই, দেশের ইতিহাসেও নজিরবিহীন! দমকলের তরফে পুলিশের কাছে ওই এফআইআর দায়ের করেছেন দমকল বাহিনীর ডেপুটি ডিরেক্টর দীপক সরকার। যিনি বলছেন, “৯০ দিনের মধ্যে নির্দেশ না-মানলে এমনিতেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা।” কিন্তু তাঁরা কি ৯০ দিন পর পরিদর্শন করেছিলেন? সেই সময়সীমা তো শেষ হয়েছে দশ দিন আগে। দীপকবাবু স্বীকার করছেন, তাঁদের তরফে পরিদর্শন হয়নি। যা বলেননি, এ দিনের ঘটনা না-ঘটলে আদৌ তা কখনও হত কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ থাকছে।
কলকাতা শহরে গত কয়েক বছরের বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেই ‘সাময়িক’ তোলপাড় শুরু হয়েছে (যেমন এ দিন দ্রুত বাতিল করা হয়েছে ঢাকুরিয়া আমরির লাইসেন্স)। আমরির ছ’জন ডিরেক্টর-সহ সাত জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাঁদের ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তির দাবিও উঠেছে। ওই ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয়েছেন শহরবাসী। কিন্তু ইতিহাস বলছে, তা একান্তই ‘সাময়িক’। এ শহরে সাম্প্রতিক অতীতে ঘটে-যাওয়া নন্দরাম মার্কেট এবং স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ড তেমনই বলছে।

আগের দুই
নন্দরাম মার্কেট

আগুন
১১ জানুয়ারি, ২০০৮
মধ্যরাতেমৃত নেই
১৩ তলা বাড়ি
পুরসভা
উপরের ৮ তলা বেআইনি
সুপ্রিম কোর্ট ওই অংশ ভাঙতে বলে
প্রায় চার বছরেও ভাঙা হয়নি
কারণ
ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক বাধা
এখন
মার্কেটের পাঁচতলা পর্যন্ত ব্যবসা চলছে
স্টিফেন কোর্ট

আগুন
২৩ মার্চ, ২০১০
দুপুরেমৃত ৪৩ জন
৬ তলা বাড়ি
পুরসভা
বেআইনি নয় কোনও অংশই
পুর-সুপারিশ অগ্রাহ্য করেই কিছু পুনর্বাসন
কারণ
ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক চাপ
এখন
কিছু বাসিন্দা থাকছেন, দোকান-রেস্তোরাঁ খুলেছে
পুরসভা বাড়ির সংস্কারের কাজ করেনি

এ শহরে যেমন ‘বেআইনি’ নন্দরাম মার্কেট ভেঙে ফেলা যায়নি রাজনীতির বাধায়, তেমনই স্টিফেন কোর্টের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৩ জনের মৃত্যুর পর বাড়ির মালিককে গ্রেফতার করা হলেও তিনি দিব্যি জামিন পেয়ে গিয়েছেন! মামলা অবশ্য চলছে আদালতে। যেমন মামলা চলতে থাকে বছরের পর বছর। দু’টি ঘটনার কোনওটিতেই এখনও পর্যন্ত কারও তেমন কোনও শাস্তিই হয়নি!
ঘটনাচক্রে, এ দিনই চিনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এক মহিলাকে। তাঁর অপরাধ? দুধে ভেজাল দেওয়া। যা এই সমাজে অহরহ হয়ে থাকে। সম্প্রতি লন্ডনের একাংশে দাঙ্গায় জড়িতদেরও দ্রুত ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তি দেওয়া হয়েছে। যা এ দেশের ক্ষেত্রে ‘বিরল’। যেমন প্রাক্তন পুলিশকর্তা অসীম চট্টোপাধ্যায় এ দিন প্রকাশ্যেই বলেছেন, “অনন্তকাল তদন্ত চললে চলবে না। কোনও মামলায় চার্জশিট দেওয়ার জন্য যেমন ৯০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া আছে, তেমনই বিচারের জন্যও নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া উচিত।”
বড়বাজারের অন্যতম পুরনো বাণিজ্যিক ভবন নন্দরাম মার্কেটে আগুন লেগেছিল ২০০৮-এর জানুয়ারিতে। পাঁচ দিন লড়াইয়ের পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছিল দমকল। তার পর থেকেই ১৩ তলা মার্কেটের উপরের ৮টি তলা বন্ধ। পুরসভা ওই অংশটি ‘বিপজ্জনক’ বলে ঘোষণা করেছিল। ওই অংশ ভেঙে ফেলারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বামফ্রন্ট পরিচালিত পুরবোর্ড। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিবাদ করেছিলেন। মার্কেটের সামনে মঞ্চ বেঁধে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিয়ে সভা করেছিলেন তিনি। তার পর থেকে তালাবন্ধই পড়ে রয়েছে মার্কেটের বড় অংশ। নন্দরাম মার্কেটের বেআইনি অংশ ভাঙায় অপারগতার বিষয়ে তদানীন্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য স্পষ্টই বলেছিলেন, “অন্য কোথাও হলে কবেই ভেঙে দিত! এখানে তো গণতান্ত্রিক সমাজ! পুরসভার টিম গেলে ওরাই (মার্কেটের ব্যবসায়ীরা) পেটাবে!” ভোট-রাজনীতির জন্য বাম এবং অ-বাম দু’তরফই বাধা দিয়েছিল নন্দরাম মার্কেটের ‘বিপজ্জনক ও বেআইনি’ অংশ ভাঙতে।

নিয়ম মানে না কেউ*
বিপজ্জনক বাড়ি
দমকল আইনে এফআইআর
মার্কেন্টাইল বিল্ডিং, কারনানি ম্যানসন ও কারনানি এস্টেট

কলকাতা পুলিশের নোটিস
জিতেন্দ্র চেম্বার, পুনওয়ানি চেম্বার্স, হেস্টিংস চেম্বার্স, তাপারিয়া হাউস, টেম্পল চেম্বার এবং কুইন্স ম্যানসন

দমকল আইনে নেটিস
বেন্টিঙ্ক চেম্বার্স
বাজার
দমকল আইনে এফআইআর
সদাসুখ কাটরা, রাজা কাটরা, সিটি সেন্টার (কলকাতা ১), বাগরি মার্কেট, কলকাতা পিঁজরাপোল সোসাইটি, বোথরা মার্কেট, গাঁধী কাটরা, যমুনা ভবন এবং জানকি সেন্টার

দমকল আইনে দু’টি মামলা
মেহতা বিল্ডিং

দমকল আইনে নোটিস
তামাপট্টি, সত্যনারায়ণ পার্ক, জৈন ভবন, শ্যামশ্রী মার্কেট, বাজরিয়া কাটরা, শ্যাম মার্কেট, মহশ্রী কমার্স লিমিটেড, টেরিটি মার্কেট, চাঁদনি চক মার্কেট, বি কে মার্কেট নতুন ও পুরনো, শান্তিনিকেতন বিল্ডিং, মানসরোবর বিল্ডিং, রাজকমল ও গগনতারা বিল্ডিং, ওঙ্কার বিল্ডিং, পঞ্জাবি কাটরা এবং মনোহর দাস কাটরা (কলকাতা ৭)
নিট ফল
একমাত্র সত্যনারায়ণ পার্ক ছাড়া কোনও বাড়ি, বাজার বা ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত ভবনের ক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি
* অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির তদন্ত-রিপোর্ট

স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডের পর কলকাতা পুলিশ ও দমকলের একটি পরিদর্শক দল মধ্য কলকাতার বিভিন্ন বাড়ি এবং বাজারের (মোট ৫১ টি) অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখেছিল। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, অধিকাংশ বাড়ি এবং বাজারেরই অবস্থা যথেষ্ট ‘বিপজ্জনক’। কিন্তু পাশাপাশি এমনও মন্তব্য করা হয়েছিল, ওই সমস্ত বাড়ির বাসিন্দারা সমস্ত বুঝেও গোটা বিষয়টিতে যথেষ্ট ‘অনীহা’ দেখাচ্ছেন। পরিস্থিতি বিচারে সেগুলিকে ‘সিল’ করে দেওয়ার সুপারিশও করেছিল ওই পরিদর্শক দল।
ওই রিপোর্টে পার্ক স্ট্রিটের একটি রেস্তোঁরা, স্ট্র্যান্ড রোডের একটি বাড়ির সঙ্গে স্টিফেন কোর্টের নামও ছিল। যেখানে ২০১০ সালের ২৩ এপ্রিল অগ্নিকাণ্ডে মারা গিয়েছিলেন ৪৩ জন। পুলিশ-দমকলের যৌথ পরিদর্শক দলের সুপারিশ না-মানার পরেও যে বাড়ির কিছু বাসিন্দাকে আবার বসবাসের অনুমতি দিয়েছে কলকাতা পুরসভা। এ দিন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, “স্টিফেন কোর্টের বাসিন্দাদের এখনও স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়নি।”
মেয়র ওই দাবি করলেও (বস্তুত, তিন মাস আগে সেই মর্মে তাঁদের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হলেও) ওই বাড়ির বেশ কিছু বাসিন্দা কিন্তু সেখানে থাকছেন। দোকান খুলে ব্যবসাও করছেন। স্টিফেন কোর্টের বাসিন্দা কমিটির সম্পাদক দেবাশিস গুহনিয়োগী এ দিন বলেন,“বর্তমান পুরসভা সব কিছু খতিয়ে দেখে জানিয়েছে, বাড়ির কোনও অংশ বেআইনি নয়। বাড়িটিতে ৭০টি পরিবার ছিল। গোটা ১৫ পরিবার কোনওক্রমে থাকার অনুমতি পেয়েছে। বাকিরা এখনও বাইরে আছে। পুরসভা ও প্রশাসন কিছু শর্ত আরোপ করেছে। সেই শর্ত মানলে সবাই ফের বাড়িতে থাকার সুযোগ পাবেন।” তাঁর আরও বক্তব্য, “আমরা শর্ত মেনে যথাসাধ্য করব। কিন্তু তার জন্য অর্থ দরকার। আগামী মাসে কাজ শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে।”
সেই পরিকল্পনা কত দূর ‘সফল’ হবে, আমরি-কাণ্ড তাতে আরও গতি আনতে পারবে কিনা, তা ভবিষ্যতই বলবে। তবে এ দিন থেকেই বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আমরি-কাণ্ডে দায়ীদের ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তির দাবিতে আন্দোলন শুরুর জন্য নাগরিক বার্তা-বিনিময় শুরু হয়েছে। সেই মতামত-বিনিময় সম্ভবত আরও গতি পাবে দিনান্তের ঘটনাপ্রবাহ জানলে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা জানালেন, আমরি হাসপাতালের ছ’জন ডিরেক্টরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। (রাতে গ্রেফতার করা হয় আর এক কর্তাকে) ধৃতদের তরফে কিছু ক্ষণ পর মনে করিয়ে দেওয়া হল, ‘গ্রেফতার’ নয়। ডিরেক্টররা ‘আত্মসমর্পণ’ করেছেন! কিছু ক্ষণ পর অবশ্য বলা হল, ‘পুলিশের বক্তব্যই ঠিক’।
শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ৮৯ জনের নিরুপায় মৃত্যুর পরেও ‘অভিযুক্ত’রা নিজেদের ‘আত্মসমর্পণকারী’র গরিমায় ভূষিত করতে চেয়েছিলেন!
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.