|
|
|
|
|
|
|
...গন্ধ এসেছে |
বাড়ি-ধারা
বারোয়ারির বাইরে বাড়ির পুজোয় নানা পরিবারে নানা রীতি।
কোথাও মাটির মূর্তি তো কোথাও ধাতুর। খোঁজ নিলেন
বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য গৌতম বসুমল্লিক |
|
|
|
ভট্টাচার্যবাড়ি, টালিগঞ্জ
পণ্ডিতবংশ হিসেবে ভট্টাচার্য পরিবারের নিজস্ব ‘পূজা-পদ্ধতি’ আছে। আশ্বিনের শুক্লা-প্রতিপদে বোধন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইট, কয়লা, চালের ব্যবসায়ী আগমবাগীশ বংশীয় পশুপতি ভট্টাচার্য বর্ধমানের রায়না থেকে এসে দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ-কলাবাগান অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। দশমীর সকালে ঘট বিসর্জনের পরে ‘দেশ’ অর্থাৎ বর্ধমানের প্রচলিত খাবার ভাত, কড়াইয়ের ডাল, পোস্ত ও মৌরলা মাছের ঝোল রান্না হয়। পুজোর সময়ে এখনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এ বাড়িতে পুজো শুরু হয় ১৯৩৪-এ।
সোনার দুর্গাবাড়ি (বেহালা)
ব্রাহ্ম সমাজ রোড। এই পরিবারের আদিপুরুষ জগৎরাম মুখোপাধ্যায়ের কন্যা জগত্তারিণী দেবী এক বার পুজো উপলক্ষে তাঁর মামার বাড়ি গিয়ে আশানুরূপ আদর না পেয়ে বাড়ি ফিরে বাবার কাছে বায়না ধরলেন যে তাঁদের বাড়িতে দুর্গাপুজো করতে হবে। পুজোর শুরু এ ভাবে। সে দিন ছিল নবমী। সে বছর ঘটেই পুজো হয়েছিল, পরের বছর মাটির মূর্তিপুজো শুরু হয়। জগৎরাম মুখোপাধ্যায়ের প্রপৌত্র যদুনাথ মুখোপাধ্যায় ঢাকার ঢাকেশ্বরী দেবীর মূর্তির অনুরূপ একটি অষ্টধাতুর মূর্তি বাড়িতে স্থাপন করেন ১৮৬৯-এ। এটি দু’ফুট উঁচু। চালিতে খোদাই করা আছে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। দেবীর সিংহ ঘোটকাকৃতি। পুজোর সময় পরানো হয় ‘রাজবেশ’। পুজো হয় তন্ত্রোক্ত বিধিতে। পুজোর সময় সকালে নিবেদন করা হয় খিচুড়ি ভোগ। দুপুরে বিশেষ অন্নভোগে থাকে ভাত, শুক্তো, ঘন্ট, ছেঁচকি, বিভিন্ন তরকারি, মাছ ভাজা, মাছের ঝোল, শোল মাছ পোড়া, চাটনি ইত্যাদি। সন্ধেবেলায় থাকে শীতল ভোগ।
হালদারবাড়ি, বেহালা
বেহালা অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন হালদার (কাঞ্জিলাল) পরিবারের একাধিক বাড়িতে এখনও দুর্গাপুজো হয়। বেহালা থানা এলাকার জোড়ামন্দির-হালদার বাড়ির পুজো তেমনই একটি প্রাচীন পুজো। আনুমানিক ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে লক্ষ্মীনারায়ণ হালদার এই পুজো আরম্ভ করেন। সাবেকি মঠচৌরী চালের ডাকের সাজের মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমা। আশ্বিনের শুক্লা-প্রতিপদে বোধন আরম্ভ হয়। এখনও এ বাড়ির বরণের ‘শ্রী’ আসে দৌহিত্র-পরিবার মুখোপাধ্যায়দের বাড়ি থেকে। হালদার বাড়িতে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিন দিনই গোবিন্দভোগ চালের ভাত, পাঁচ রকম ভাজা, সুক্তো, বিভিন্ন আনাজের তরকারি, পায়েস এবং রাতে লুচি, ভাজা, মিষ্টি ভোগ দেওয়া হয়। দশমীতে দেওয়া হয় পান্তা ভাত ও কচুর শাকের তরকারি। হালদার বাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জন হয় পারিবারিক পুকুরেই।
রঘুনাথ শিরোমণির পুজো, তালতলা
রঘুনাথ শিরোমণি ছিলেন নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিত। তাঁর এক বংশধর দেওয়ান উমেশচন্দ্র চক্রবর্তী ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাণ্ডুয়া থেকে কলকাতায় এসে তালতলা অঞ্চলে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক বাড়িটি কিনে সেখানে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। এই পুজোটি রঘুনাথ শিরোমণির পুজো নামে পরিচিত। পুজোর খরচ নির্বাহের জন্য ‘দেবত্র-এস্টেট’ রয়েছে। একচালা মহিষাসুরমর্দিনী ডাকের সাজের প্রতিমা। ষষ্ঠীর দিন হয় বোধন। সপ্তমীর দিন বাড়ির দালানেই হয় কলাবৌ-স্নান। নবমীর দিন সকালে হোমের আগে খাঁড়া পুজো এখানকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
বন্দ্যোপাধ্যায়বাড়ি, পটুয়াটোলা
১৭৮৫-তে ২৪ পরগনার নবগ্রাম থেকে কলকাতায় আসেন রামহরি বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি থাকতেন সাবেক পটলডাঙা অঞ্চলের পটুয়াটোলা লেনের ৫৪ নম্বর বাড়িতে। সেখানে খড়ের চালার এক চণ্ডীমণ্ডপ নির্মাণ করে ১৭৯১-এ তিনি দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। পরে পরিবারের এক অধস্তন পুরুষ বিপিনবিহারী ৯ নম্বর বাড়িতে তিন খিলানের পাকা ঠাকুরদালান তৈরি করে পুজোটি সেখানে স্থানান্তরিত করেন। বোধন আরম্ভ হয় প্রতিপদে। এখানকার পুজো হয় কালিকাপুরাণ মতে। তাই এখনও সপ্তমী, অষ্টমী, সন্ধিপুজো ও নবমীতে পশুবলি প্রথা বজায় আছে। এই পরিবারের এক সদস্য ভারতের প্রথম অ্যাটর্নি বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯০-এ ওই রাস্তার ৮ নম্বর বাড়িতে আরও একটি দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন।
জগজ্জননী মন্দির
মানিকতলা স্ট্রিট (অধুনা শিশির ভাদুড়ী সরণি)। এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন জনার্দন সাহা ও মুকুন্দমুরারি সাহা। দেবীর সপরিবার এই মূর্তিতে রয়েছে কিছু বৈশিষ্ট্য। যেমন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ এক চালিতে পাশাপাশি অধিষ্ঠিত। চালিতে আঁকা আছে পট ও কলকা। বিশেষ পুজো হয় চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজোর সময়। এ ছাড়াও পুজো হয় ঝুলন, জন্মাষ্টমী ও রাসে।
নীলমণি দে-র ঠাকুরবাড়ি
বৌবাজার, হিদারাম ব্যানার্জি লেন। ১৮৯৬ সালে নীলমণি দে প্রতিষ্ঠা করেন এই ঠাকুরবাড়ির। অষ্টধাতুর সপরিবার দুর্গামূর্তি। পিছনের চালিতে আঁকা আছে পট। পুজো শুরু হয় মহালয়া থেকে। প্রতিপদে হয় ঘটস্থাপন। ষষ্ঠীতে হয় বোধন। রূপোর সিংহাসনে দেবীকে বসানো হয়। পুজোর ভোগে থাকে লুচি, কচুরি, নিমকি। নিবেদন করা হয় বাড়িতে তৈরি মিষ্টি যেমন বোঁদে, মালপোয়া, সন্দেশ ইত্যাদি, জানালেন এই পরিবারের সন্ধ্যা দাস (দে) ও পঞ্চানন দে।
দেওয়ানজিবাড়ি
বৌবাজার, হিদারাম ব্যানার্জি লেন। দালানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করুণাময়ী দুর্গা। এই পরিবারের অরূপ মুখোপাধ্যায় জানালেন, তাঁদের পূর্বপুরুষ হৃদয়রাম মুখোপাধ্যায় এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দুর্গাপুজো ছাড়াও দুর্গামূর্তিতেই হয়ে থাকে কালী ও জগদ্ধাত্রী পুজো। কালীপুজোর সময় দুর্গামূর্তির উপর কালীর মুখোশ পরানো হয়। ছটি হাত কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়ও অন্য কাপড় দিয়ে হাত ঢেকে দেওয়া হয়। পুজোর সময় সাতখিলেনের ঠাকুরদালানের সিংহাসনে দেবীকে স্থাপন করা হয়। পুজোর সময় নবপত্রিকা বাড়িতেই স্নান করানো হয়। সারা বছর দেবীর ভোগে মাছ থাকলেও পুজোর সময় থাকে বিশেষ নিরামিষ ভোগ। সপ্তমীতে একটি, অষ্টমীতে দু’টি ও নবমীতে একটি কুমারীপুজো হয়ে থাকে। দশমীর দিন কেবল মাত্র ঘট ও নবপত্রিকা বিসর্জন হয়ে থাকে। হয় কনকাঞ্জলি।
শ্যামলধন দত্তের বাড়ির পুজো, সিমলা
হাটখোলা দত্ত পরিবারের শ্যামলধন দত্ত ১২৮৯ বঙ্গাব্দে সিমলার ১৫৯ বলরাম দে স্ট্রিটে নতুন বাড়ি কিনে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। পুজোটি পরে শ্যামলধনের দৌহিত্র বংশ ঘোষেদের হাতে চলে যায়। বর্তমানে তাঁরাই করেন এই পুজোটি। উল্টোরথের দিন কাঠামো পুজো হয়। মঠচৌরী চালের সাবেকি বাংলা শৈলীর শোলার সাজের মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমা। এখানে নব্যমাদিকল্প অনুসারে আশ্বিনের কৃষ্ণানবমী থেকে সাত জন পুরোহিত চণ্ডীপাঠ করেন। পঞ্চমীতে বোধন। সপ্তমী থেকে নবমী প্রতি দিন সকালে এবং সন্ধিপুজোয় রাধাবল্লভি, লুচি, খাস্তাগজা, দরবেশ, নারকেল নাড়ু, লেডিকেনি এই সাত পদের ভোগ দেওয়া হয়। দত্তবাড়ির পুজোয় পশুবলি হয় না। নবমীর দিন সকালে সাদা পর্দার আড়ালে চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। দশমীর দুপুরে হয় দরিদ্রনারায়ণ সেবা।
সিংহবাড়ি, পদ্মপুকুর
সিংহ পরিবারের আদি পুজোটি হত নদিয়ার বড় জাগুলিয়ার বাড়িতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে, মাধবচন্দ্র সিংহ দক্ষিণ কলকাতার ২৬ পদ্মপুকুর রোডে ঠাকুরদালান-সহ বসতবাড়ি নির্মাণ করে পুজোটি সেখানে নিয়ে আসেন। সিংহবাড়ির প্রতিমায় এখনও কিছু সাবেকি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। দু’পাশে মকরমুখ-শোভিত সিংহাসনে উপবিষ্ট বাংলা শৈলীর মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমা। মঠচৌরী চালের বাঁ পাশে ছিন্নমস্তা, রামসীতা ও শুম্ভনিশুম্ভ বধ, মাঝে দক্ষিণাকালী, শিবদুর্গা আর ডান পাশে জটায়ু-রাবণ-সীতা ও রাধাকৃষ্ণের চিত্র। ছাপা চালচিত্র নয়, চালিশিল্পী সাধন পাল এখনও হাতে আঁকেন সিংহবাড়ির চালির চিত্র। এ ছাড়াও চালিতে রয়েছে বিষ্ণুর দশ অবতার, শিব ও রামের ছোট মূর্তি। বোধন আরম্ভ হয় আশ্বিনের শুক্লা-প্রতিপদ তিথি থেকে। এক সময়ে জীববলির প্রচলন থাকলেও এখন তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নবমীর দিন নবঘটে নবদুর্গার পুজো এখানকার পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
পুরনো মিত্রবাড়ি, চক্রবেড়িয়া
পলাশির যুদ্ধের পরে নতুন কেল্লা (এখনকার ফোর্ট উইলিয়ম) তৈরির জন্য সাবেক গোবিন্দপুর অঞ্চলের বাসিন্দাদের পুনর্বাসন দেওয়া হয় বিভিন্ন জায়গায়। ভবানীপুর পুরনো মিত্রবাড়ির পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, এই পরিবারের প্রাণপুরুষ রামগোবিন্দ মিত্র ছিলেন সিরাজদ্দৌল্লার দেওয়ান। আরও অনেকের সঙ্গে তিনিও ভবানীপুর অঞ্চলে পুনর্বাসন পেয়ে ঠাকুরদালান-সহ ভদ্রাসন তৈরি করে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে। পুরনো ঠাকুরদালানটি এখন আগের চেহারায় নেই। সাবেকি একচালা ডাকের সাজের বাংলা শৈলীর মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমা। ষষ্ঠীতে বোধন হয়। সপ্তমীর দিন কলাবৌ স্নান হয় পুজোর দালানেই। দশমীর সকালে অপরাজিতার পুজো এখানকার বৈশিষ্ট্য।
মোক্তারবাড়ি, রাজারহাট
রাজারহাটের মহিষগোট গ্রামের মোক্তারবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন গোপাল মোক্তার। তাঁর ছয় ছেলে ১৩১৭ বঙ্গাব্দে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। একচালা সাবেকি মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমা। পুজো আরম্ভ হয় ষষ্ঠীর দিন। মোক্তারবাড়ির পুজোয় সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতি দিন সকালে খিচুড়ি, বিভিন্ন রকম ভাজা, ফল-মিষ্টি ইত্যাদি ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়।
পুজো উপলক্ষে মোক্তার পরিবারের সদস্যরা মিলিত হন।
কাত্যায়নী দুর্গা (কাশ্যপবাড়ি)
নিউ আলিপুর। এখানে বিশেষ পুজো হয় কেবল মহাষ্টমী তিথিতেই। প্রাচীন এই পুজো শুরু হয়েছিল পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরের পালং গ্রামের কোটাপাড়ার কাশ্যপ বাড়িতে। রাজা রাজবল্লভ এই মূর্তিটি পরিবারের আদিপুরুষ নারায়ণ ভট্টাচার্যকে দিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকে এই মূর্তিটি প্লেনে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। কাত্যায়নী-র বিশেষত্ব হল দুর্গার সামনের দুটি হাত বড় আর পিছনের আটটি হাত আকারে ছোট। দেবীর মুখ লম্বাটে। সিংহ ঘোটকাকৃতির। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ ছাড়াও এখানে উপস্থিত জয়া বিজয়া। আর কোনাকৃতি চালির উপর রয়েছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। মহালয়ার দিন একটা বড় গামলায় দেবীকে স্নান করানো হয়। ষষ্ঠীর দিন দেবীকে নতুন বেনারসি শাড়ি ও সোনার গয়না পরিয়ে সিংহাসনে স্থাপন করা হয়। অষ্টমীর বিশেষ পুজোর ভোগে থাকে খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, কুমড়োর ছক্কা, ইলিশ মাছ, পায়েস ইত্যাদি। |
|
|
|
|
|