|
|
|
|
|
|
সুরিচেন লা |
...এখনও ধকল সয় |
রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য |
বয়স মুখের রেখায় ত্রিকোণমিতি শেখাতে শুরু করেছে। হাল্কা হচ্ছে চুল। হাঁটুতে টান ধরছে। আছে আসন্ন অবসরের চিন্তাও। এ সময় কি নতুন কিছুর খোঁজে বেরনো সম্ভব?
আমবাঙালির উত্তর জানা নেই, তবে দেবাশিস বর্ধন, সুদীপ্তি বন্দ্যোপাধ্যায়, আশিস গঙ্গোপাধ্যায় ও তুহিন মিত্র হ্যাঁ-ই বলবেন। কারণ, তাঁদের মতে, ইচ্ছে প্রবল হলে বয়স বাধা নয়। সেই ইচ্ছের টানেই সম্প্রতি ‘অ্যারেট মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশন’-এর হয়ে তাঁরা খুঁজে বার করলেন সুরিচেন লা যাওয়ার পথ। এ দলের সদস্যদের গড় বয়স ৫৪ বছর। |
|
তথ্য-বিপ্লবের এই যুগেও সুরিচেন লা তেমন পরিচিত নাম নয়। এমনকী ‘সর্বজ্ঞ’ গুগ্ল ঘেঁটেও বিশেষ তথ্য মেলে না। ফলে এই অভিযানের ঝুঁকি ছিল কিছু বেশিই, জানালেন এই অভিযানের দলপতি দেবাশিস বর্ধন। পেশায় রেলকর্মী দেবাশিসবাবুর সঙ্গে পাহাড়ের সম্পর্ক প্রায় দু’দশকের। গঙ্গোত্রী, কালিন্দী-১, ভাগীরথী-১-এর মতো নানা অভিযানের সাফল্য তাঁর ঝুলিতে রয়েছে। ঝোঁক ‘টেকনিক্যাল ক্লাইম্বিং’-এর দিকে। “আসলে আমাদের মনে একটি প্রশ্ন ছিল। হিমালয়ের এই অঞ্চলে অনেক অভিযান হয়েছে। কিন্তু কেউ কেন সুরিচেন লা অতিক্রম করেনি?” বললেন দেবাশিসবাবু।
অনুসন্ধিৎসার এই টানেই দলে ভিড়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক সুদীপ্তি বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় ৪৫ বছর ধরে হিমালয়ের আনাচেকানাচে ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতায় ঋ
দ্ধ তিনি। হেঁটেছেন ভারতের উপকূল ও কয়েকটি প্রধান নদীর তীর ধরেও। “ভালবাসা ও শারীরিক সক্ষমতাএই দুই থাকলে সব বাধাই পেরিয়ে যাওয়া যায়। পাসটি খুঁজে পাওয়ার পাশাপাশি পৌঁছানোর সহজ রাস্তাটিও বার করার ইচ্ছে ছিল,” বললেন সুদীপ্তিবাবু। ছিলেন তুহিনবাবুও। বললেন, “১৪ বছর বয়স থেকেই পাহাড়ে ঘুরে বেড়াই। নতুন পথ আমাকে সব সময় টানে। তাতে বিস্তর ঝামেলা থাকে। হাতড়ে হাতড়ে ঠিক পথ বার করতে হয়, আর সেটাই তো মজা।”
প্রায় ১৫ হাজার ফুট উচ্চতায় কিলিং সরাইয়ে মূল শিবির। এখান থেকেই প্রকৃত অভিযানের সূচনা। যদিও প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল আগেই। ছিল ছুটি ও সরঞ্জাম জোগাড়, ‘ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশন’-এর অনুমোদন আদায়ের মতো নানা ঝঞ্ঝাটের কাজ। খরচ? তা-ও নিজেদের পকেট থেকেই। এর পরে পথে দু’টি শিবির গড়তে হয়। দু’দিনে দীর্ঘ পথ হাঁটার পাশাপাশি পেরোতে হয়েছে অনেকগুলি খরস্রোতা নদীও। “আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম। রোপ ফিক্স করে নদী পার হই। আবহাওয়া ভাল থাকায় বিশেষ সমস্যা হয়নি,” বললেন সুদীপ্তিবাবু। দেবাশিসবাবুর কথায়: “আমাদের দীর্ঘ সমতলভূমির মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে। শুধু ঘাস। অক্সিজেন কম। দিনে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও উঠেছে। রাতে নেমে যেত হিমাঙ্কের দুই ডিগ্রি নীচে। ফলে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লাগে। বয়স বেশি হলে সমস্যা আরও বাড়ে।” এ দলের চতুর্থ সদস্য, ব্যাঙ্ককর্মী আশিস গঙ্গোপাধ্যায়। প্রায় তিন দশক পাহাড়ে বিচরণ। বললেন, “প্রতিটি অভিযানেই কম-বেশি কষ্ট হয়। মনে করি, আর যাব না। কিন্তু পাহাড়ই আবার কান ধরে ঘরের বাইরে টেনে আনে। এ এক বিচিত্র টান।” |
|
চতুর্থ শিবির হয় ফির্তসে লা-র মুখে। ফির্তসে অভিযাত্রীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় পাস। কিন্তু তাঁদের মনে হয় আরও পশ্চিমে গেলে মিলতে পারে সুরিচেনের সন্ধান। পঞ্চম শিবির হয় ১৭ হাজার ফুট উচ্চতায়। এর পরে আক্ষরিক অর্থেই হাতড়ে বেড়ানো। একশো মিটার অন্তর ‘গ্রিড ম্যাপ’ ও কৃত্রিম-উপগ্রহের ছবি দেখতে হচ্ছিল। প্রচণ্ড জোরে ঠান্ডা হাওয়াও বইছিল। “আমরা কিছুটা ভয়ও পেয়েছিলাম। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পরিশ্রমের পরে আমরা এমন একটি জায়গায় পৌঁছই যার দক্ষিণ-পশ্চিমে রামজাক শৃঙ্গ এবং ঠিক পশ্চিমে নান-কুন শৃঙ্গ। আর নীচেই ঘোড়ার জিনের মতো একটি পাস। বুঝতে পারি এটিই সুরিচেন লা। উচ্চতা তখন ১৮৪৮৮ ফুট,” বললেন দেবাশিসবাবু।
শেষ দিনে আশিসবাবুর খুব কষ্ট হয়েছিল। কারণ, ওখানে অক্সিজেন বেজায় কম। মুখ ফুলে গিয়েছিল। রাত দশটার পরে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে পৌঁছান। “ক্লান্তিতে শরীর চলছিল না। কিন্তু খুঁজে পাওয়ার আনন্দ সব ভুলিয়ে দেয়। এটাই তো পাহাড়ে ‘চালিকা শক্তি’, যা বার বার আমাদের টেনে নিয়ে আসে রুদ্ধ ঘরের কোণ থেকে উন্মুক্ত আকাশতলে। আসল প্রাপ্তি তো এটাই,” শান্ত স্বরে বলে উঠলেন আশিসবাবু। |
|
|
|
|
|