প্রতি পক্ষ
সাহসিনী, ফের মঞ্চে
সেই যে ‘ইতি তোমাদের চরণতলাশ্রয়চ্ছিন্ন মৃণাল’ বলে একটি মেয়ে, নাকি বউ বললেই বোধহয় ঠিক হয়, চলে গেল মুক্তির দিকে, চার দিকে পড়ে থাকল ঘরকন্নার টুকরোটাকরা আর অনেকখানি অন্যায়, যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়েই তো সেই বধূটির গৃহত্যাগ!
এই পর্যন্ত বললেই নির্ভুল মনে পড়বে ‘স্ত্রীর পত্র’, আর ঠিক তার পরেই চোখের সামনে আর একটা ছবি। আর এক সাহসিনী। সীমা বিশ্বাস।
সম্প্রতি কলকাতায় একটি নাট্যোৎসবে ‘স্ত্রীর পত্র’-র একক অভিনয়ে আরও এক বার জ্বলে উঠলেন তিনি। জীবনে এমন মুহূর্ত খুব বেশি আসে না, যখন অভিনীত চরিত্র এবং ব্যক্তিগত জীবন নিহিত কোনও সুতোয় জুড়ে যায়, একটা আগুন নিয়ে আসে আর একটা আগুনের দহন, চোখের সামনে মঞ্চমায়া আর যাপিত জীবন এক হয়ে যায় মুহূর্তে।
অসমের নলবাড়ির মেয়ে, জগদীশ এবং মীরা বিশ্বাসের সন্তান পৃথিবীতে চক্ষু মেলেই যে পরিবেশটি পেয়েছিলেন, তাতে এ যেন প্রায় নির্ধারিতই ছিল যে শেষমেশ মঞ্চই হবে এর ঠিকানা। হলও। মা অসমের সুখ্যাত নাট্যকর্মী, মেয়েও জানে না মঞ্চভীতি কাকে বলে!
(সীমা অবশ্য এখানে মৃদু আপত্তি করছেন। জানা গেল, কোথাও কোনও সুচিন্তিত বক্তব্য রাখতে নাকি তাঁর ভীষণ ভয়। এক বার ‘ব্যান্ডিট কুইন’-এর পরে অসমেই একটি সভায় তাঁকে কিছু বলতে বলা হয়েছিল, সেই কাজটুকু করতে গিয়ে সীমা বিব্রত হয়েছিলেন বেজায়) নাটক নিয়ে অসমে একটি কর্মশালায় এসেছিলেন ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা’, সংক্ষেপে এন এস ডি-র এক শিক্ষক! সেই হল সীমা-র এন এস ডি-তে পা রাখার সূচনা! আবার ‘এন এস ডি রেপার্টরি কোম্পানি’-র একটি অভিনয়ের শেষে সাজঘরে এলেন শেখর কপূর। তিনি ছিলেন দর্শকাসনে। সীমাকে গিয়ে অভিনন্দন জানালেন, এবং তার পরেই প্রস্তাব, ফুলন দেবী-র চরিত্রে অভিনয় করবেন!
বাকিটা ইতিহাস, এবং বহুচর্চিত ইতিহাস। সুতরাং, নতুন করে বলার কিছু নেই! যা বলার তা এই যে, সেই একটি ফিল্মে অভিনয়ের পরেই সীমা বিশ্বাস বিখ্যাত হলেন, অজস্র সম্মান এবং শিরোপা, কিন্তু ক্রমে কোথাও যেন হারিয়ে যেতে থাকল তাঁর প্রথম টান, তাঁর শিকড় মঞ্চ!
এখনও কেমন লাগে যখন নিয়ম করে প্রতিটি সাক্ষাৎকারে এক বার না এক বার ফুলন দেবীর কথা আসবেই, এবং তখন হাসি হাসি মুখে, বা মুখে ছদ্ম ভীতি টেনে কেউ জিজ্ঞেস করবেন, আচ্ছা, কেমন লেগেছিল ওই সিন-টা শুট করার সময়?
‘ওই সিন’ মানে কোনটা তা আর আলাদা করে উল্লেখ না করলেও চলবে। সেই দৃশ্য যেখানে সর্বসমক্ষে হাঁটছেন ফুলন, গায়ে সুতোটি পর্যন্ত নেই!
সীমা-র আক্ষেপ থেকে যায়, ‘বডি ডাবল’ শুট করল, অথচ সেই সাহসী, এবং ভারতীয় সিনেমায় কার্যত নজিরবিহীন দৃশ্যটির জন্য স্বীকৃতি তাঁরই কাছে আসে।
১৯৯৫-৯৬-এর সেই ছবির পরে দীর্ঘ প্রায় কুড়ি বছরে বহু চরিত্রে স্মরণীয় অভিনয় করেছেন তিনি, খামোশি, কম্পানি, ভূত বা ওয়াটার, অথচ লোকে যে তাঁকে ওই ‘ফুলন’ হিসাবেই মনে রাখল, সে-ও কি সীমার আর একটা আক্ষেপ!
জানা যায় না। তিনি নিজেও জনগণমনের এই ধাঁচের সঙ্গে নিজের মনটাকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। তবু, ভিতরে কোথাও কি কোনও দহন হয় না।
সীমা উত্তর দেন না, কিন্তু ভিতরের সেই আগুনই বেরিয়ে আসে তাঁর দাপুটে মঞ্চ-উপস্থিতির মধ্যে!
পলকে তিনি ফের প্রথম যৌবনে। দিল্লি। এন এস ডি। নাটক নিয়ে তুমুল হইহল্লা, ফুটলাইট আর স্পটলাইটের আলোয় জীবনকে দেখার সব দিন।
সেই সব মুহূর্ত ঝড়ের মতো যদি ঘুরে বেড়ায় তাঁর ভিতরে, তারাই কি ফিরে আসে ‘স্ত্রীর পত্র’-র মৃণালের সংহত, কিন্তু উত্তাল চরিত্রায়ণে।
সীমা বিশ্বাস ‘স্ত্রীর পত্র’ করেছেন, কারণ মৃণালের ওই স্বাধীনচিত্ত প্রতিবাদের সঙ্গে তাঁর জীবনটাও কোনও একটা জায়গায় মিলে যায়।
‘ব্যান্ডিট কুইন’-এর চিত্রনাট্য হাতে পেয়েই মনে হয়েছিল, এই চরিত্রটা একদমই আমার, জানান সীমা।
‘স্ত্রীর পত্র’-র প্রতিবাদিনী ‘মৃণাল’-ও কি তাঁরই জন্য গড়া নয়? সেই মৃণাল যে সমস্ত ছাঁচ ভেঙে চেয়েছিল, ভেবেছিল নিজেই নিজের জীবনের একটা ছাঁচ গড়ে নেবে, সমাজ যখন তাকে মানতে চাইল না, চাপিয়ে দিল নিজের বিধান, তখন সে খুব শান্ত এবং দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখ্যান করল সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বিধান!
এই বিপুল প্রত্যাখ্যান কি, একটি গভীর অর্থে, সীমা বিশ্বাসেরও নিজস্ব ধ্রুবপদ নয়?
উত্তর দেওয়ার জন্য সীমা নেই আর, তিনি চলে গিয়েছেন সাজঘরে।
পর্দা উঠবে। থার্ড বেল পড়ে গেল!



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.