|
|
|
|
|
|
|
পুজোর বেড়ানো... |
শাল-পিয়ালের কুচকাওয়াজ
কখনও একমুঠো কাঁচা গ্রাম হুস্ করে উড়ে যায়।
চৈতি বাতাসে টুপটাপ ঝরে মহুয়া। লিখছেন জগন্নাথ ঘোষ |
|
ট্রেনটা এক ছুটে গড়ধ্রুবেশ্বর পেরিয়ে গেল। তার পর কাঁটাডি, উরমা। এগুলিও বিস্তীর্ণ টাঁড়ে ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকা ছোট ছোট স্টেশন। দু’পাশে ছুটে যাচ্ছে উঁচু-নিচু মালভূমি। কাছে-দূরে ঢ্যাঙা তাল, খেজুরঝোপ। কখনও একমুঠো কাঁচা গ্রাম হুস্ করে উড়ে গেল। ট্রেনের গতি ক্রমশ কমে আসছে মানে সামনে বরাভূম স্টেশন। নিচু প্ল্যাটফর্ম। পাশের লাইনে একরাশ ওয়াগন নিয়ে সিগন্যালের অপেক্ষায় ফুঁসছে ডিজেল ইঞ্জিন। ওয়াগনে কাঁচা লোহা পিণ্ড, ঝাড়খণ্ডের খনিজ সম্পদ। ট্রেন থেকে নেমেই চোখে পড়বে যূথবদ্ধ গাভীন মোষ আকাশের প্রান্তে। এই যাত্রা ওই সব পাহাড়ের ঘেরাটোপে।
দুই নদী কাঁসাই এবং শাঁখা পেরিয়ে যাওয়ার পরে দৃশ্যে জুড়ে গেল বিপুল শাল, পলাশ, কেঁদু, কুসুম। বাঁশিটাঁড়ের মুখে এসে থামতেই হচ্ছে। পথটাকে বাঁকের মুখে রুখে দিয়েছে পাহাড় মুররাবুরু। এখান থেকেই ক্যামেরার খাতা খোলা শুরু। ডাইনে জঙ্গল চিরে রয়ে গেল ডিগারডি গ্রামখানা। সেখানে গেরস্থর দুয়ারে দাঁড়ানো শাল, কুসুম, মহুয়া। সে মহুয়া চৈতি বাতাসে টুপটাপ ঝরে। ফুলে যত রস, গন্ধে শরীর অবশ। সামনে ভুচুন্ডির মোড়ে সুঁড়ি পথের জোড়-এ এক গ্রামীণ দোকানে গরম ‘ভাবরা’ ভাজা আর রসাল লবঙ্গলতা উপাদেয়। দোকানের পিছনেই পাহাড়, জঙ্গল। তার পর থেকে শুরু হল সবুজের ফৌজি মহড়া। মাঝের পিচ সড়কটা মাঠা বনকুঠি, বুড়াবুড়ি হিল, গজা পাহাড়ের ঢেউ সামলে, কুদলুং নদী পিছলে, রেরেংটাঁড় সনকুপি গ্রাম ফেলে যখন ছাতাটাঁড়ের মোড়ে পৌঁছল, ক্যামেরা ভরে উঠেছে ছবির সম্পদে। এই ছাতাটাঁড় দোকান বাজার হোটেল নিয়ে খুদে মফস্সল। |
|
এ যাত্রায় গুটিকয় পাহাড়ি গ্রাম পরিক্রমা। জল, জঙ্গল, পাহাড় ছুয়ে পৌঁছে যাওয়া সাঁওতাল, কুর্মি, কালিন্দি পাড়ায়। সেই মতো বাঘমুন্ডি বাজারের গাড়ি জুড়ে পাড়ি দেওয়া কয়রাবেড়া জলাধার। তার আগে খিরাবেড়া গ্রামের মুখে সড়কের উপরেই এক দেশোয়ালি দোকানের কঞ্চির বেঞ্চে বসে নাস্তা সারা গরম কচুরি-কারি, মোতিহারি লাড্ডুতে। সামনে নীল দিগন্ত, পিছনে পাহাড়ে পাহাড়ে প্রাণান্ত। এমন দৃশ্য ও খাদ্য চোখে দেখা, চেখে দেখা তৃপ্তিকর। কাররু নদী পেরিয়ে কড়েং-এর মুখে ছোট্ট বাজারপাড়া ছেড়ে ডান দিকের পথ ধরে মাঠ-ঘাট-গ্রাম ঠেলে পাহাড়ের চক্রব্যূহে হঠাৎ ঢুকে পড়ে, আপনি যেন একলা অভিমন্যু। সেই পাহাড়ে ফুটে আছে ভরভরি ফুল, ধাদ্কি, খটাংডুমুর। আর পাহাড়ি গামলায় বিস্তীর্ণ এক জলাধার। পাহাড়ের পিঠের উপরে জঙ্গলের পকেটে গ্রাম পিটিদিবি, তোলয়াভাসা, জিলিং। মেয়েরা জঙ্গলের সিঁথি বেয়ে সেই সব গ্রামে যেতে পথে ফেলে যায় ঝুমুরের কলি‘পিরিতি কাঁটা বিঁধেছে গো মরমে/ওলো সই আমি মরি যে শরমে।’ সঙ্গে চলেছে সারিন্দা (তারের বাদ্য) বাজিয়ে ভূমিজ পুরুষ। গানের ফুলকি উড়ে এসে প্রাণে, ভিন্ন মাত্রা জুড়ে দেয় ভ্রমণে। |
|
পাহাড় ফাটিয়ে চওড়া পথখানা বেঁধে দিয়ে জাপানি প্রযুক্তি যে দিন ড্যাম গড়ল, পথ জুড়ল, তখনই প্রান্তজনের কপাল পুড়ল। বামনকাটা, গোলবুনম, ডংরা এই ডানামেলা পাহাড়গুলি ধুলো হয়ে গেল। গাবরিয়া, ঝাঁটাজুড় জঙ্গল পাতাল ড্যাম-এ তলিয়ে গেল। এই সব তথ্য ঘাটোয়াল মানুষের মুখে মুখে। আর পাহাড়ু ঘনশ্যাম যেমন জঙ্গলের শব্দকোষ, তেমনটাই তার জানোয়ারের শব্দ-বোধ। কোন বনে সূর্যমুখী চলে সে বলে। এই প্যাঙ্গোলিনের মাংস নাকি টাইগার মোরগ থেকেও সুস্বাদু। পাহাড়ি চড়াই ভরে আছে পাকা ভেলাই ফলে, ভূতভৈরবীর কমলা ফুলে। হিলটপ থেকে দেখা যাচ্ছে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের দুই জলাধার। অনেকটা নীচে গাঢ় নীল পাতাল ড্যাম। উপরে সাদা পাথরের ট্রেতে আকাশ সায়র। পাহাড়ে ফুটে আছে লাল কোহলি ফুল, দেদার গামার, বসন্তে পলাশ রক্তে তামাম পাহাড় বধ্যভূমি। হাতিনাদা গ্রাম ছেড়ে আরও টং-এ রাঙা গ্রাম সাঁওতালদের। পাড়ায় জাহিরা থানের (দেবস্থান) প্রাঙ্গণে বললেই নেচে দেবে অলকার দল ‘দং’ কিম্বা ‘লাংড়ে’। এ দিকে ছবির স্টিকার হয়ে আরও গ্রাম বারুয়াজারা, টাঁড়পানিয়া, টিকরটাড়। এই সব সাঁওতাল-ভূমিজ পাড়া ঘিরে গ্রাম-পর্যটন গড়ে উঠবে অদূর ভবিষ্যতে। তখন গ্রামবাসীর মাটির ঘরে দিনযাপন, মেয়েদের হাতের ব্যাঞ্জন কুদলুং নদীর দাঁড়কা, ঝরা মাছ, শোভা নদীর ভ্যালসা মাছের হরেক পদ, মোটা ভাত, পিয়ালের চাটনিতে হবে অতিথি আপ্যায়ন। |
|
বিরহড়দের গ্রাম ভূপতিপল্লি। দূরত্বে সামান্যই। অবলুপ্তপ্রায় এই উপজাতির যাপন প্রণালী এখনও আদিম কালের। ওদের মধ্যে ‘উথুল’ শ্রেণি যাযাবর প্রকৃতির আর ‘জাঘিরা’ সামান্য কৃষিকাজ শিখেছে। বিরহড়দের পাতার কুম্বয় বাস, বাবই ঘাসের চাষ। আর খাদ্য বিনা উপবাস। সহজ কথায় এই ওদের পরিচয়। কচি ‘গাড়ি’ অর্থাৎ শিকার করে, সিদ্ধ করে স্রেফ লবণ দিয়ে সঙ্ঘ-ভোজ এখনও ওদের মধ্যে প্রচলিত। আর ভোজ মানেই হাঁড়িয়া পান, নাচ এবং গান। ভূপতিপল্লি থেকে নেমে পূর্ব দিকে ভুচুন্ডি থেকে বাঁয়ে ঘুরে মুররা পাহাড়ের নিবিড় জঙ্গলে গ্রাম ধসকা। এখানে পাহাড়ের গর্ভে লুকনো আদিবাসী স্কুলটি দেখলেই বালকবেলায় ফিরতে ইচ্ছে হবে। পাহাড়ের পেটে বসে একটা মজলিশি আড্ডা হলে তো কথাই নেই। তবে এ পথে হঠাৎ হাতির হামলা হলে নাকি স্কুল ভণ্ডুল।
সফরের শেষ দিনে চাঁদনি রাতের ক্যাম্পফায়ারে স্থানীয় জনের হাসিখুশি বেপরোয়া উচ্ছ্বাসে, মাদলের মাতনে ডাহার নাচবে সাঁওতাল মেয়েরা। সঙ্গে আড্ডা, গল্প, গান আর সাঁওতালি কুদুমে (ধাঁধা) বুঁদ হয়ে ফেরা। এই সব পাহাড় অরণ্য জলাধার, টুর্গা বামনি নদীখাত, প্রান্তিক জীবনের স্বাদ আর স্থানীয় ছেলেদের হাত ধরে দুর্গম ডাউরিতে ট্রায়াল ট্রেক, সব জুড়ে গড়ে ফেলুন আগামী দিনের ছুট-এর ছক। এই তো শুরু উড়ানের মরসুম।
|
ছবি: রঞ্জন মুখোপাধ্যায় |
|
|
|
|
|