|
|
|
|
বনধ-অবরোধ-ধর্মঘটে ইতি |
‘সদিচ্ছা’ দেখাচ্ছেন মমতা, তবে আরও পথ বাকি |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বনধ-অবরোধের ‘ঐতিহ্য’ থেকে রাজ্যকে ‘মুক্তি’ দেওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘সদিচ্ছা’ আরও এক বার প্রমাণ করেছেন ঠিকই। সরাসরি বিধানসভায় দাঁড়িয়ে করজোড়ে সব দলের কাছে আবেদন করেছেন, রাজ্যের স্বার্থে বনধ-ধর্মঘট-অবরোধের পথ থেকে সকলেই যেন সরে আসেন। কিন্তু ধর্মঘট বনধ করতে যা করা প্রয়োজন, সেই শ্রম আইন সংস্কারের জন্য কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের উপরে শরিক হিসেবে তিনি ‘চাপ’ সৃষ্টি করতে পারবেন কি?
প্রত্যাশিত ভাবেই, মমতার আবেদনে এখনও সাড়া দেয়নি সিপিএম এবং বিজেপি। সিপিএমের মতোই রাজ্য বিজেপি-রও মত, বনধ-ধর্মঘট-অবরোধ নিষিদ্ধ করা হলে তা হবে ‘গণতন্ত্র হত্যাকারী পদক্ষেপ’। দু’দলেরই বক্তব্য, বিরোধী দলে থাকার সময় মমতা নিজের ইচ্ছেমতো বনধ ও অবরোধ করেছেন। এখন প্রশাসক হিসেবে অসুবিধা হবে ভেবেই সে রাস্তা থেকে অন্যদের সরতে বলছেন। ঘটনাচক্রে অবশ্য মমতা যখন দলীয় স্তরে বনধ বনধ করেছিলেন, তখন লোকসভায় তাঁর বিপুল জয়ও হয়নি।
আদালতের নির্দেশে এ দেশে ‘বনধ’ নিষিদ্ধ হলেও আদতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্রেফ নাম পাল্টে ‘হরতাল’ বা ‘সাধারণ ধর্মঘট’ ডেকে সাধারণ মানুষকে সেই একই দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দেয় রাজনৈতিক দলগুলি। শিল্প ধর্মঘটের জেরেও পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায় জনজীবন। এমনিতে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাইব্যুনাল আইনে’ ধর্মঘটের অধিকার স্বীকৃত। সুতরাং, আইন করে কিছু করতে হলে সেই স্বীকৃত অধিকার ‘বাতিল’ করতে হবে। যে ভাবে মমতা বনধ-ধর্মঘট-অবরোধের বিরুদ্ধে হাঁটছেন, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক হিসাবে তিনি ‘চাপ’ সৃষ্টি করতে পারেন শ্রম আইন সংস্কারের জন্য। ঘোষিত লক্ষ্য সত্ত্বেও ইউপিএ যা এখনও করে উঠতে পারেনি।
বনধ-ধর্মঘট বিরোধীদের বক্তব্য, প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে কাজ না করাটা যেমন অধিকার, তেমনই কাজ করাটাও অন্য পক্ষের অধিকার। এ ক্ষেত্রে গায়ের জোরে সংখ্যালঘিষ্ঠের মত সংখ্যাগরিষ্ঠের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটাই বিচার্য। রাজ্য প্রশাসনের এক আধিকারিকের কথায়, “ধরা যাক, একটি সংস্থায় একটি ইউনিয়ন ধর্মঘটের পক্ষে। কিন্তু ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা যা, তার চেয়ে বেশি কর্মচারী কাজ করতে চান। তাঁদের মতের উপর কী করে ইউনিয়ন তার মতামত চাপিয়ে দেয়?”
যদি একান্তই ধমর্ঘট হয়, তা হলে, সেটা যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মচারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে না হয় তা নিশ্চিত করতে ‘স্ট্রাইক ব্যালট’-এর প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারেও উদ্যোগী হতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রসঙ্গত, কোনও একটি পরিস্থিতিতে ধর্মঘটই প্রতিবাদের ‘উপযুক্ত’ পথ কি না, তা নিয়ে কর্মচারীদের মতামত যাচাই করা হয় ‘স্ট্রাইক ব্যালটে’। সাধারণত, যে সব ক্ষেত্রে ধর্মঘট হলে বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে, সেখানে প্রয়োজন বিশেষে এই প্রথা মানা হয়। যেমন, সাম্প্রতিক কালে টেলিকম ধর্মঘটের সময় সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ‘স্ট্রাইক ব্যালট’ নিয়েছিল।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তীর অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন, “শ্রমিকদের মত না-থাকলে কখনও ধর্মঘট হয়? নাকি তাদের মত ছাড়া কোনও ইউনিয়ন ধর্মঘটে যেতে পারে?” ঘটনাচক্রে, বনধ বা হরতালের ক্ষেত্রে ইউনিয়নের তরফে সকলের মতামত জানতে চাওয়াটা এ রাজ্যে তো বটেই, দেশেও বিরল।
মমতার মতে, তাঁর দল তৃণমূল তিন বছর আগে থেকেই ‘পথ’ দেখিয়েছে। বাকিরা সেই পথ অনুসরণ করলে সার্বিক ভাবে রাজ্যেরই লাভ। তবে প্রশাসনের একাংশ মনে করছে, শুধু ‘সদিচ্ছা’র উপরে নির্ভরশীল হয়ে না-থেকে মমতা বাকি পদক্ষেপগুলি করলে বিষয়টি সর্বভারতীয় স্তরে আরও গুরুত্ব পাবে। তাতে রাজ্যের অন্য রাজনৈতিক দলগুলির উপরেও একটা ‘পরোক্ষ চাপ’ তৈরি হবে। মমতা এর আগে হরতাল-ধর্মঘট রুখতে প্রয়োজনে আইন করার কথা বলেছিলেন। মঙ্গলবার তিনি বিধানসভায় ওই বিষয়ে সর্বদল বৈঠক ডাকার কথা জানিয়েছেন।
তৃণমূল শিবিরের মতে, মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে ‘গণতান্ত্রিক পথে’ এগোতে চান বলেই সর্বদল বৈঠক ডাকতে চান। গত লোকসভা ভোটে বিপুল সাফল্যের আগে থেকেই মমতা তাঁর দলকে বনধ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। সেই উদাহরণ দেখিয়েই তিনি বাকি দলগুলির কাছে আবেদন করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলি যে এখনও ধর্মঘটকে প্রতিবাদের ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ বলে মনে করে, তা বুঝেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আইন পাশ করিয়ে নেওয়ার পথে হাঁটতে চাননি মমতা। তাঁর যুক্তি, তিনি ‘সদিচ্ছা’ দেখিয়েছেন। এ বার বাকিরাও দেখান।
তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “ছুতোনাতায় বনধ, ধর্মঘট বা অবরোধ প্রতিবাদের যুক্তিযুক্ত পদ্ধতি হতে পারে না। সেটাই গত তিন বছর বলে আসছেন আমাদের নেত্রী। সেটা মানতে কোনও দলেরই আপত্তি নেই। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পরে সে কথা বলেছেন। তার ভিত্তিতেই মুখ্যমন্ত্রী সর্বদলীয় সহমত তৈরি করতে চাইছেন।” তবে মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে সর্বদল বৈঠকে গেলেও বামেরা বন্ধের হাতিয়ার শিকেয় তুলে রাখার প্রস্তাবে সায় দেবেন না। সর্বদল বৈঠকে ‘ঐকমত্য’ (এ ক্ষেত্রে যা না-হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল) না-হলে
তাঁর ‘সদিচ্ছা’ রূপায়ণে কোন পথে এগোন মমতা,
তা-ই দেখার।
পশ্চিমবঙ্গকে বনধ-অবরোধের ‘ঐতিহ্যে পরিচিত’ করানোর ‘দায়’ ঐতিহাসিক ভাবেই বামেদের। যদিও তাঁদের বক্তব্য, ক্ষমতায় আসার আগে দীর্ঘ দিন মমতাও ‘ধ্বংসাত্মক রাজনীতি’ করেছেন। এখন বামেদের প্রস্তাব, মুখ্যমন্ত্রীর উচিত আগে মালিকদের নিয়ে বসা। শ্যামলবাবুর কথায়, “উনি (মুখ্যমন্ত্রী) মালিকদের বলুন, শ্রমিকদের পিএফ-গ্র্যাচুইটির টাকা মিটিয়ে দিতে। শ্রমিকেরা কাজই করতে চান। তাঁদের ন্যূনতম অধিকারের কিছু প্রশ্ন মালিকেরা মেনে চললে শ্রমিকদের মিছিল করারও দরকার পড়ে না!” সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুরও মত, “শ্রমিক ইচ্ছা করে ধর্মঘট করে না। এটা তো সর্বদল বৈঠকে আলোচনার বিষয় হতে পারে না!”
মমতার সরকারের আমলে বিধানসভায় প্রতিনিধিত্বের নিরিখেই সর্বদল বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে দলগুলিকে। বিধায়কহীন বিজেপি সেই তালিকায় পড়ে না। তবে সর্বদলে ডাক পেলে বনধ-প্রশ্নে তাঁদের প্রতিবাদের কথাই বলবেন বলে বিজেপি নেতৃত্ব জানাচ্ছেন। আর শ্যামলবাবু বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রী এখন বলছেন, ট্রেড ইউনিয়নকে ডাকবেন। এর আগে বারবার চিঠি দিয়ে ইউনিয়নগুলি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। উনি দেখা করেননি। শেষ পর্যন্ত শ্রমমন্ত্রী কথা বলেন। তিনিও মোটেই ভাল ব্যবহার করেননি। তার মানে, যখন মুখ্যমন্ত্রী চাইবেন, তখনই দরকার! তবু আমরা গিয়ে আমাদের কথাগুলো বলে আসব।” |
|
|
|
|
|