জাদুকাঠির ছোঁয়ায় যেন বদলে গিয়েছে ছবিটা!
বাসে ভিড়, বাজারে ভিড়। রাস্তায় লোক। স্টেশনেও যাত্রী প্রচুর। স্কুলে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা। খোলা সরকারি দফতর, দোকানপাট, হাটবাজার। স্কুল-কলেজও। হিংসার কোনও চিহ্ন নেই। ঘটেনি কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা।
দীর্ঘ দিন পরে এমনই এক অচেনা বনধ দেখল জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ অংশ। বাঁকুড়ার খাতড়া থেকে পুরুলিয়ার বলরামপুর, পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম, সাঁকরাইল থেকে গোপীবল্লভপুর বা শালবনিজনগণের কমিটির ডাকা বন্ধে বুধবার ছিল একই ছবি। বনধ-অবরোধের বন্ধ্যা রাজনীতিতে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যাওয়াই যে জঙ্গলমহলের দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এমন ‘পরিবর্তন’-এর বনধ শেষ কবে দেখা গিয়েছে, তা মনে করতে পারছেন না রাজনৈতিক নেতা থেকে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারাও। |
ব্যতিক্রমও আছে। ঝাড়গ্রাম শহর বা লালগড়, বেলপাহাড়িতে বনধ হয়েছে কার্যত সর্বাত্মক। তবু তার মধ্যেও জঙ্গলমহলের একটা বড় এলাকার মানুষ যে ভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় বেরিয়েছেন, সেটা এর আগে কখনও দেখা যায়নি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবারই বলেছেন, “বনধ-অবরোধ-রাস্তা রোকো ঐতিহ্য হতে পারে না।” এ দিনের জঙ্গলমহল যেন মুখ্যমন্ত্রীর সেই কথাকেই স্বীকৃতি দিল। |
তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’ ও ‘এলাকা দখলের রাজনীতি’র প্রতিবাদে বুধবার তিন জেলার জঙ্গলমহলে ২৪ ঘন্টা বন্ধের ডাক দিয়েছিল জনগণের কমিটি। তাৎপর্যপূর্ণ হল, বন্ধের রাজনীতি থেকে কিছুটা সরেছে কমিটিও। তারা শেষবার বনধ ডাকে ১১ ফেব্রুয়ারি। ছ’মাস পরে তাদেরই বন্ধে রাস্তায় নেমে জঙ্গলমহলের একটা বড় অংশের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘ঢের হয়েছে, আর নয়!’
বস্তুত, গত আড়াই বছরে কমিটি-মাওবাদীর লাগাতার বনধ-অবরোধের রাজনীতির জাঁতাকলে বারবার জেরবার হয়েছেন জঙ্গলমহলের মানুষ। স্থানীয় অর্থনীতি মার খেয়েছে। দিনের পর দিন দোকান খুলতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। রুজিতে টান পড়েছে দিন আনি দিন খাই গরিব মানুষদের। বিশেষ করে যাঁরা জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে হাটে বিক্রি করেন বা কেন্দুপাতা সংগ্রহ করাই যাঁদের জীবিকা। ২০০৯-এ লোকসভা নির্বাচনের পরে জনগণের কমিটির আন্দোলনেই মাসের পর মাস অবরুদ্ধ হয়ে ছিল বাঁকুড়ার সারেঙ্গা ব্লক। |
ভিতরে ভিতরে ক্ষোভ তাই জমছিলই। তারই জেরে এ দিন অনেক জায়গায় বনধ উপেক্ষা করার সাহস দেখাল আম-জনতা। মাওবাদী-কমিটির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ‘জন জাগরণ মঞ্চে’র নেতা নিশীথ মাহাতোর কথায়, “দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জঙ্গলমহলের মানুষ অবশেষে বুঝতে পেরেছেন, সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে যে কোনও অশুভ-শক্তিই পিছু হঠতে বাধ্য।”
টুকরো ছবিতেই তা স্পষ্ট। |
দক্ষিণ বাঁকুড়ার মহকুমা সদর খাতড়ায় স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, বাজার খোলা ছিল। বিভিন্ন রুটে বাস-ট্রেকার চলছে। এমনকী মাওবাদী প্রভাবিত বলে পরিচিত রানিবাঁধ, বারিকুল, সারেঙ্গা, রাইপুরেও অনেক দোকানপাট, স্কুল, সরকারি অফিস খোলা ছিল। যা কয়েক মাস আগেও ভাবা যেত না। একই ভাবে ঝাড়গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়া ছ’নম্বর জাতীয় সড়কে এ দিন লরি-ট্রাক চলাচল স্বাভাবিক ছিল। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম ব্লকের খড়িকামাথানি চকে আগের বনধ হয়েছিল সর্বাত্মক। এ দিন সেই চক ও বাজার এলাকা ছিল জমজমাট। শালবনির পিড়াকাটা এলাকার এক প্রাথমিক শিক্ষক বললেন, “কমিটির ডাকা বন্ধে আগের বার স্কুল বনধ রাখতে হয়েছিল। এ বার খোলা ছিল। আমিও মোটরবাইকে অনেকটা পথ পেরিয়ে স্কুলে এসেছি। এটা কিছু দিন আগেও ভাবতে পারতাম না।”
গত দু’বছরে যে বলরামপুরে মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন কমপক্ষে ২৯ জন, এ দিন সেখানেও উলটপুরাণ! অধিকাংশ স্কুল খোলা ছিল। শিক্ষক-পড়ুয়াদের হাজিরাও প্রায় স্বাভাবিক। এমনকী বলরামপুরের বরাভূম স্টেশনে রেলের উদ্যোগে হওয়া স্বাস্থ্য শিবিরে বনধ উপেক্ষা করেই হাজির হয়েছেন শয়ে শয়ে পুরুষ-মহিলা। আদ্রা-চাণ্ডিল শাখায় ট্রেন চলাচল ছিল স্বাভাবিক। |
সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্রের ব্যাখ্যা, “মাওবাদী ও জনগণের কমিটির অবরোধ আন্দোলনের জন্য বারবার এখানকার বাসিন্দাদের রুজিতে টান পড়েছে। তাই এ বার মানুষ সাড়া দেননি।” জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি শ্যামল সরকারের অবশ্য দাবি, “জঙ্গলমহলের মানুষ বুঝতে পেরেছেন, নতুন সরকার তাঁদের উন্নয়নের লক্ষ্য কাজ করছেন। তাই তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই বনধ সমর্থন করছেন না।”
তা হলে লালগড়, বেলপাহাড়ি বা ঝাড়গ্রামে বনধ সর্বাত্মক কেন? রাজ্য পুলিশের আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) জুলফিকার হাসানের ব্যাখ্যা, “ওই এলাকায় দিনের পর দিন মাওবাদী-কমিটির হিংসা ও বীভৎসতা দেখেছেন মানুষ। তাঁদের আতঙ্ক রাতারাতি কাটা মুশকিল। তবে ভবিষ্যতে এখানকার মানুষও বন্ধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন।”
পুলিশ-কর্তার আশাটাই বোধহয় এই বন্ধের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। |