|
|
|
|
বিপন্ন সৈকত/৪ |
অবৈধ নির্মাণের জেরে সঙ্কটে সোনালী সৈকত |
কথায় বলে সমুদ্র যা নেয়, তা ফিরিয়েও দেয়। পূর্ব মেদিনীপুরের সাগর তীরের বাসিন্দাদের জীবনে
অবশ্য এ আপ্তবাক্য ফলেনি। সমুদ্র ভাঙনে এখানকার অনেকেই চিরতরে সর্বস্ব খুইয়েছেন। ভয়াল প্রকৃতি,
উদাসীন প্রশাসন আর রমরমা অবৈধ নির্মাণের ত্র্যহস্পর্শে সঙ্কটে সৈকত পর্যটন কেন্দ্রগুলিও।
এই সঙ্কট কেন? আনন্দবাজার-এর অনুসন্ধান। |
সমুদ্র-ভাঙন রোধের স্থায়ী সমাধান হয়তো মিলবে একদিন। কিন্তু স্বার্থন্বেষী মানুষের ধ্বংসাত্মক কাজকর্মে ততদিনে সৈকতের কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে উপেক্ষা করেই পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগর ব্লকের মন্দারমণি, সিলামপুর, সোনামুই আর দাদনপাত্রবাড়এই চারটি উপকূলবর্তী গ্রামে সমুদ্র প্লাবনভূমিতে গড়ে উঠেছে আস্ত একটা পর্যটনকেন্দ্র। সৈকতের কোলেই গজিয়ে উঠেছে বড় বড় হোটেল-লজ। যানবাহন চলাচলে ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে সৈকততট। আর রাতের অন্ধকারে সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে সমুদ্রবাঁধ থেকে বালি চুরির হিড়িকে বালিয়াড়ি তার উচ্চতা হারাচ্ছে ক্রমশ।
সৈকতের উপরেই হোটেল-লজ। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাই সৈকতের উপর বোল্ডার ফেলা থেকে প্রাচীর নির্মাণ সব কিছুই করছেন হোটেল মালিকেরা। সৈকতের উপর দিয়ে ইট-বালি বোঝাই লরি থেকে প্রতি দিনের ট্রেকার চলছে নিয়মিত। ফলে সৈকতের আসল শ্রী-ই হারিয়ে যেতে বসেছে। একদিন যে সোনালি বেলাভূমি লাল কাঁকড়ার নির্ভয় বিচরণ ভূমি ছিল, সেই সৈকত এখন যেন চাষজমি। হারিয়ে গিয়েছে লাল কাঁকড়া।
এর প্রতিকার করতে মন্দারমণিতে তট নিয়ন্ত্রণ রেখার মধ্যে তৈরি হওয়া হোটেল-লজগুলিকে বেআইনি নির্মাণ ঘোষণা করে ভেঙে ফেলার নিদের্শ দিয়েছিল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদ। সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে হোটেল মালিকরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলে হাইকোর্ট স্থিতাবস্থা জারি করে। সেই স্থিতাবস্থা এখনও বহাল রয়েছে বলে মন্দারমণি সি-বিচ হোটেলিয়ার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক দেবদুলাল দাস মহাপাত্র জানান। দেবদুলালবাবুর কথায়, ‘‘মন্দারমণিতে তট নিয়ন্ত্রণ রেখা আদৌ চিহ্নিত হয়নি। বেশ কয়েক বছর আগে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ তট নিয়ন্ত্রণ রেখা নির্ধারণ নিয়ে এক বৈঠক ডাকে। সেই বৈঠকে দূষণ পর্ষদের পক্ষ থেকে যে তট নিয়ন্ত্রণ রেখা চিহ্নিত করা হয় তা দাদনপাত্রবাড় বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। ওই রেখার মধ্যে কলকাতা বন্দর, মৎস্য দফতরের যেমন অফিস রয়েছে, তেমনই স্কুল, জনবসতিও রয়েছে। সেই কারণে ওই রেখা নির্ধারণে তৎকালীন মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দ ও জেলা সভাধিপতি নিরঞ্জন সিহি আপত্তি জানালে বৈঠক ভেস্তে যায়। তার পর আর কোনও বৈঠক হয়নি। তাই মন্দারমণিতে তট নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘনের কোনও প্রশ্নই উঠে না।’’ |
|
এ ব্যাপারে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অফিসে যোগাযোগ করলে পর্ষদের অফিস থেকে বিষয়টি হাইকোর্টের বিচারাধীন জানিয়ে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করা হয়।
মন্দারমণিতে বেআইনি হোটেল নির্মাণ অভিযোগও অস্বীকার করেছেন দেবদুলালবাবু। তাঁর কথায়, নিয়মানুসারে স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে অনুমতি নিয়েই হোটেল নির্মাণ হয়েছে। প্রত্যন্ত মন্দারমণিতে রাজ্যের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পূর্ণ কৃতিত্ব হোটেল ব্যবসায়ীদের দিয়ে কাঁথি মহকুমা মৎস্যজীবী উন্নয়ন সমিতির কার্যকরী সম্পাদক লক্ষ্মীনারায়ণ জানা আবার বলেন, ‘‘স্বাধীনতার ৬০ বছর পরেও উপকূলবর্তী ওই চারটি গ্রামে নেই কোনও পথ চলার রাস্তা। সৈকতের উপর দিয়েই চলাফেরা করতে হয় চারটি গ্রাম আর ২টি মৎস্যখটির প্রায় ২০ হাজার মানুষজনকে। সরকারি উদাসীনতায় আজও গ্রামে এসে পৌঁছয়নি বিদ্যুতের আলো, পানীয় জল। এলাকার মৎস্যজীবীদের কাছে নিজস্ব বলতে ছিল রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পাট্টা পাওয়া কিছু জমি যা মূলত সৈকতের বালিয়াড়ি। সেই জমি কিনে হোটেল মালিকেরা হোটেল-লজ বানানোয় আজ কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে এলাকায়।”
হোটেল-লজ নিয়ে এই বিতর্কের মাঝেই নতুন এক সমস্যাসৈকতের খাসজমি হিসাবে চিহ্নিত বালিয়াড়ি কেটে নিশ্চিহ্ন করার বেআইনি প্রয়াস। রাজ্য ভূমি ও ভূমি সংস্থার দফতর থেকে ইতিমধ্যেই বালিয়াড়ি কেটে বালি লুঠ করার জন্য বেশ কয়েকজনের নামে রামনগর থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। মৎস্য দফতরের কিছু জমিতেও বালিয়াড়ি কেটে বালি চুরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য অধিকর্তা সুরজিৎ বাগ। পুলিশে অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা হয়নি বলে তাঁর দাবি।
শুধু সরকারি উদাসীনতাকে দায়ী করাটা দায় এড়ানোরই নামান্তর। প্রকৃতির উপরে খবরদারি বন্ধ করতে এগিয়ে আসতে হবে আমজনতাকেই। না হলে যে ভাবে চলছিল, সে ভাবেই চলবে। উপকূল ভাঙন থেকে শুরু করে বেআইনি নির্মাণরোখা যাবে না কিছুই।
|
(শেষ) |
|
|
|
|
|