প্রবন্ধ ২...
কে ‘আদর্শ’ নাগরিক প্রশ্নটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ
জাতীয় স্তরে অণ্ণা হজারের লোকপাল-আন্দোলনের দ্বিতীয় দফাটি চলছে। কয়েক মাস আগে, এই আলোড়নের প্রথম দফার শেষে সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দী একটি সাক্ষাৎকারে এ দেশে গণতন্ত্রের অনুশীলন প্রসঙ্গে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিভাজনের কথা বলেছিলেন। অনুবাদ করলে তা মোটামুটি এই যে, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র (ইনস্টিটিউশনালাইজড ডেমোক্র্যাসি) এবং গণতন্ত্রের সংস্কৃতি (কালচার অব ডেমোক্র্যাসি)। এই ভাবনাটুকু, অন্তত ওই সাক্ষাৎকারের সীমিত এবং সীমাবদ্ধ পরিসরে খুব একটা এগোনোর অবকাশ পায়নি, কিন্তু ওই চিন্তাসূত্র ধরে আমরা পৌঁছে যেতে পারি আশিস নন্দীরই আর একটি লেখায় ‘কালচার, স্টেট অ্যান্ড দ্য রিডিসকভারি অব ইন্ডিয়ান পলিটিক্স’ যে লেখার মধ্যে তিনি এই ভাগাভাগির কথা অনেকটাই ছড়িয়ে বলেছেন। অণ্ণা হজারের সাম্প্রতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে সেই কথাগুলি একটু ফিরে দেখা ভাল।
এই কারণে যে, অণ্ণার দলবল (লোকমুখে ‘টিম অণ্ণা’)-র কার্যকলাপের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ, এই আন্দোলন ভারতে গণতান্ত্রিক অনুশীলনের পদ্ধতিটিকেই ব্যাহত করতে চায়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অণ্ণাকে সদ্য যে চিঠি পাঠিয়েছেন, তাতে দ্ব্যর্থহীন ভাবে লেখা, “যে কোনও ব্যক্তির সঙ্গে সরকার আলোচনায় প্রস্তুত। কিন্তু আইন প্রণয়নের সময় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও সংসদের স্বাধিকারকে মাথায় রাখতে হবে।” এক দিকে পত্রাকারে এই বক্তব্য, যাকে সরকারি ভাষ্যের সারাৎসার বলে ভাবাই সঙ্গত অন্য দিকে রামলীলা ময়দানে জনস্রোত, আই আই টি খড়্গপুরের সমাবর্তনে শিক্ষার্থীর মাথায় গাঁধীটুপি, সেই শ্বেতশুভ্র টুপিই আবার বলিউডের বিভিন্ন তারকাখচিত মস্তকে, টুইটার-ফেসবুকে ঝড় বোঝা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের বিপরীতে কোথাও একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠছে যা নিজেকে গণতন্ত্রের সংস্কৃতি বলেই অভিহিত করতে চাইছে। সব থেকে বড় কথা, এদের মধ্যে একটা দেওয়াল গড়ে উঠছে কোথাও।
‘কোথাও’ শব্দটা একটু ঝাপসা। আসলে এই ভাগাভাগির ছবিটা কোথায়, তা ততটা ঝাপসা নয় মোটেই। আশিস নন্দীর যে লেখাটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে আগে, সেই লেখার মধ্যেই এই ভাগরেখার ছবিটি আঁকা ছিল। তিনি জানাচ্ছেন, একটি শিবির সারা ক্ষণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দিব্যি দেয়, অন্য পক্ষ রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার উপরে সংস্কৃতিকে রাখতে চায়। এই দ্বিতীয় পক্ষটি, আশিস জানাচ্ছেন, ব্যক্তির রাজনৈতিক অংশগ্রহণ (পলিটিক্যাল পার্টিসিপেশন) এবং রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ (পার্টিসিপেশন ইন স্টেট-ওরিয়েন্টেড পলিটিক্স) এই দু’টি বিষয়কে সম্পূর্ণ ভিন্ন বর্গে রাখতে চায়। প্রথমটা যদি ‘লোকনীতি’ হয়, দ্বিতীয়টি হল ‘রাজনীতি’।
প্রশ্নটা হল, কী ভাবে এদের দেখব, এবং ভাগ করব? একটা সহজ সূত্র দিচ্ছেন আশিস। ‘লোকনীতি’ মনে করে জাতি-রাষ্ট্রের রাজনীতি আসলে বড় একটা আখ্যানের একটা অংশমাত্র, এবং সর্বোপরি, গণতন্ত্রীকরণের কাজটাই আসল, তাতে যদি জাতি-রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চালু প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয়, বা কার্যত বৈধতা হারানোর দশায় চলে আসে, তাতে পিছিয়ে গেলে চলবে না। অর্থাৎ, পরিভাষায় যাকে ‘সিস্টেম লেজিটিমেসি’ বলা হচ্ছে (প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও সংসদের স্বাধিকার’), তা-ই শেষ কথা নয়। বরং, গণতন্ত্রীকরণের কাজটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমন নয় যে এদের ভাব-ভাবনার মধ্যে কোথাও রাষ্ট্রীয় সংস্রব নেই, কিন্তু কথাটা এই যে, শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়াই অন্তিম লক্ষ্য নয় এদের কাছে, বরং বিদ্যমান রাষ্ট্রে গণতন্ত্রীকরণের প্রক্রিয়াটা ঠিকমতো চালু আছে কি না, তা নিশ্চিত করাটাকেই এরা নিজস্ব কর্তব্য বলে মনে করে।
অণ্ণা হজারের নেতৃত্বে যে আন্দোলন চলেছে, তাকে অবিকল এই বর্গে ফেলা যাবে কি না, কোথাও এই আন্দোলনটিও রাষ্ট্রের সমান্তরালে একটি ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠতে চাইছে কি না, তা নিয়ে তর্ক বিস্তর। অরুণা রায়ের মতো অনেকেই বলেছেন, লোকপাল শক্তিশালী এবং স্বাধীন হতেই পারে, কিন্তু এতটা ক্ষমতাশালী যেন না হয় যাতে সেই অবাধ এবং অপ্রতিহত ক্ষমতাই তাকে দুর্নীতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। এই লেখার মধ্যে সেই তর্কের ভিতরে প্রবেশ করতে চাইছি না, কিন্তু এই সূত্রে অন্য একটি ভাবনার কথা পাড়তে চাই এই লেখাটির দ্বিতীয় ভাগে।
নাগরিকের ‘আদর্শ’ সেই দ্বিতীয় কথাটি এই যে, যাকে আদর্শ ‘নাগরিক’ বলা যাবে, তার ধাঁচের মধ্যেই কি পরিবর্তন চলে আসছে কোথাও? রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের বিন্যাস নির্ণয় করতে গিয়ে নীরজা গোপাল জয়াল একটি লেখায় মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, নাগরিকের অধিকার তখনই ঠিকঠাক বিকশিত হতে পারবে, যখন দু’টি জিনিস যথাযথ ভাবে কাজ করবে। প্রথমত, সার্বিক একটি আইনি প্রক্রিয়া এটা নিশ্চিত করবে যে, সংবিধান নাগরিকের যে সমানাধিকারের কথা বলেছে, তা ঠিকঠাক মেনে চলা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সেই সমানাধিকার যাতে যথাযথ ভাবে প্রযুক্ত হতে পারে, তেমন একটি সামাজিক পরিস্থিতিও সৃষ্টি হওয়া দরকার।
সম্প্রতি অণ্ণা হজারে যে আলোড়নের মুখপাত্র হয়ে উঠলেন, তার দিকে একটু গভীর ভাবে তাকালে মনে হয়, নাগরিক অধিকারের সুষম বণ্টনের যে বন্দোবস্ত, তার ভিতরেও কি দেখা দিচ্ছে একটা ঘূর্ণিপাক! দুর্নীতির অভিযোগই যখন আন্দোলনের কেন্দ্রে, সেই শলাকা দিয়েই যখন প্রধানমন্ত্রী-সহ গোটা ব্যবস্থাটিকেই বিদ্ধ করার দাবি উঠেছে, তখন কি এ কথা মনে হয় না যে, সার্বিক আইনি-রাজনৈতিক ব্যবস্থাটির উপরেই নাগরিকের আস্থা নেই আর? জওহরলাল নেহরুর জীবনী লিখতে গিয়ে ফ্রাঙ্ক মোরেজ জানিয়েছেন, ১৯৪৫-এ জেল থেকে বেরিয়ে নেহরু ঘোষণা করেছিলেন, স্বাধীন ভারতে কালোবাজারিদের বাতিস্তম্ভে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে! ধরা যাক, সত্যিই সেটা হল! কে ঝোলাবে কালোবাজারিদের! রাষ্ট্র? মানে, রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া? না কি, নাগরিক?
সন্দেহ নেই, প্রশ্নটা কাল্পনিক, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে মনোযোগও দাবি করে। পরিভাষায় যাকে ‘এজেন্সি’ বলে, দুর্নীতি-বিরোধী সংগ্রামে সেই ‘এজেন্সি’ কার? রাষ্ট্রের, না নাগরিকের? নেহরু কার কথা বলতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে গবেষণা চলতেই পারে। কিন্তু, সাতষট্টি বছর আগের এই বক্তব্য, অজান্তেই যেন, একটা ভাগাভাগির সংকেত রেখে গিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় পরিসর, নাগরিকের পরিসর। আজ কি তবে সেই বিচ্ছেদই পূর্ণ হওয়ার দিকে এগোচ্ছে নয়াদিল্লির রামলীলা ময়দানে? এরা একেবারে পরস্পর-বিরোধী চটজলদি এমন একটা সিদ্ধান্তে চলে আসা অতি-সরলীকরণের চূড়ান্ত, কিন্তু বিরোধিতার জায়গাগুলি খেয়াল করা দরকার।
এক দিকে বিধিবদ্ধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। অন্য দিকে, সেই সংস্কৃতি যা নিজেকে গণতন্ত্রের অনুসারী হিসাবে ঘোষণা করছে এবং জনমনে যার ছাপও পড়ছে খুব দ্রুত। অণ্ণা হজারে অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে উঠছেন নাগরিকের ব্যক্তিগত পাপমোক্ষণের পরিসর! একদা বছরে কয়েক দিন চরকা কেটে যে পাপমোচনের অনুভূতি হত, অধুনা অণ্ণা হজারের সমর্থনে কিছুক্ষণ বা কিছু দিন অবস্থান সেই জায়গাটি নিয়েছে। তাতে অবশ্য বিষয়টির গুরুত্ব ক্ষুণ্ণ হয় না। গণমন এবং গণসংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করতে গেলে এই ঘটনাটিকে নিছকই ‘হুজুগ’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হাস্যকর। বরং, এই সংস্কৃতি যা দুর্নীতির প্রতিরোধে সমান্তরাল একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তার গভীরতর আলোচনা জরুরি। যাঁরা এই আন্দোলন চালাচ্ছেন, গণমাধ্যমে তাঁরা বারংবার জানাচ্ছেন, তাঁরা দেশের ভাল চান। যাঁরা এই আন্দোলন যথাসম্ভব প্রতিরোধ করতে চাইছেন, গণমাধ্যমে-তাঁদেরও বক্তব্য, তাঁরাও দেশের শুভাকাঙ্ক্ষী।
রাষ্ট্র, দেশ, এবং সমাজের এই বিচিত্র ঘূর্ণির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন নাগরিক। তিনি ভোট দেন, ফলে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেন। তিনি অণ্ণার সমর্থনে আইন ভাঙতে উদ্যত। সেটাও তো তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার। প্রথমটি রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া। দ্বিতীয়টি ব্যক্তির পছন্দ। তা হলে কে আদর্শ নাগরিক? প্রথম জন, না দ্বিতীয় জন? আবার, যদি একই অঙ্গে একাধিক রূপ দেখা যায়, তখন?
নিছকই মেনে নেওয়া বা ছুড়ে ফেলা, গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের সাদামাটা গল্পে এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। বরং, খেয়াল রাখা যাক। ‘লাইভ’ সম্প্রচার চলছে। আরও কিছু দিন চলবেও, নিশ্চিত।

কৃতজ্ঞতা:
১. দ্য রোমান্স অব দ্য স্টেট, আশিস নন্দী, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৩
২. দ্য স্টেট অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি ইন ইন্ডিয়া অর হোয়াট হ্যাপেনড টু ওয়েলফেয়ার, সেকুলারিজম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, নীরজা গোপাল জয়াল (ডেমোক্র্যাসি ইন ইন্ডিয়া, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০১)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.