|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
আন্দোলন প্রশ্নাতীত নয়, তুচ্ছ করারও নয় |
অণ্ণা হজারের পিছনে যে আসমুদ্রহিমাচল, তা সর্বব্যাপী নয়, সব শ্রেণিকে সমান আন্দোলিতও করছে না।
কিন্তু যাদের করছে, ততটা প্রতিনিধিত্বের গৌরবই বা কোন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির আছে?
গৌতম রায় |
মণিপুরের ইরম শর্মিলা রাজ্য থেকে সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন (যার বলে সেনারা যে-কোনও মণিপুরিকে জঙ্গি সন্দেহে গুলি করে মারতে পারে) প্রত্যাহারের দাবিতে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অনশন করছেন। তাঁকে গ্রেফতার করে জোর করে টিউব দিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে। অনেকেই সে কথা জানেন। তবে সারা দেশে তা নিয়ে কোনও আলোড়ন নেই। শর্মিলার দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে কালা-কানুন রদের দাবিও তো খুব বেশি লোককে তুলতে শোনা গেল না। অথচ সেই ২৬ কোটি মধ্যবিত্ত অণ্ণা হজারের দুর্নীতি-বিরোধী অনশন নিয়ে উদ্বেল।
দুর্নীতি, বিশেষত আর্থিক অনিয়ম এমনিতে অতিশয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যাপার। দুর্নীতিগ্রস্তকে তাই হাতেনাতে ধরা যায়। একই সঙ্গে দুর্নীতিকে সুকৌশলে একটি ইন্দ্রিয়-অতীত বর্গেও রূপান্তরিত করা যায়, যেমনটা ইন্দিরা গাঁধী করেছিলেন তাকে ‘একটি আন্তর্জাতিক প্রবণতা’ আখ্যা দিয়ে। তখন আর সেই ‘আন্তর্জাতিক প্রবণতা’র জাতীয় বহিঃপ্রকাশগুলো শনাক্ত করার কিংবা তাদের বিরুদ্ধে লড়বার দায় থাকে না। আর্থিক অনিয়মের মতো স্থূল দুর্নীতির বিরুদ্ধে আলোচনায়, আন্দোলনে, প্রতিবাদে মধ্যবিত্ত বড়ই মুখর। কিন্তু ক্ষমতা ব্যবহার করে, নিয়ম ও রীতি বাঁকিয়ে বা লঙ্ঘন করে অনুগৃহীতের প্রাপ্তিযোগের ব্যবস্থা করে যে-দুর্নীতি, তা লাইসেন্স-রাজের অবসানের সঙ্গে অদৃশ্য হয়নি। বরং রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারের সঙ্গে আর্থিক উদারীকরণের মিলনে রাজবৃত্তের আপাদমস্তকে চারিয়ে গেছে। ক্রম-উদীয়মান মধ্যশ্রেণির--সরকারি কর্মচারী, কর্পোরেট সংস্থার ছোট-মেজো ম্যানেজার-অফিসার, দোকানদার, ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ী ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্ক আছে সমাজের সর্বস্তরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা সেই দুর্নীতির। সেই সূক্ষ্ম দুর্নীতিপরায়ণতার মধ্যে আজন্ম বেড়ে-ওঠা প্রজন্মও অনায়াসে স্পর্শগ্রাহ্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হতে পারে, রাস্তায় নামতে পারে, মোমবাতি জ্বালতে পারে। অণ্ণা-সমর্থক যে ‘ওয়াই জেনারেশন’কে আমরা শপিং মলগুলোয় টাকা ওড়াতে দেখি, তাদের অনেকেই দিব্যি শুদ্ধ বিবেক নিয়ে এই আন্দোলনে শামিল। যেন তারা নিজেরা আদৌ এই প্রবণতায় প্রভাবিত, নিমজ্জিত নয়, যেন ওটা বাইরের সমাজের অনৈতিকতার ব্যাপার, অভ্যন্তরীণ কোনও সুবিধাবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তা ছাড়া, এই গাঁধীবাদী অর্থাৎ অহিংস আন্দোলনে ঝুঁকিও নেই। পুলিশ ভুলে লাঠি-চার্জ করে ফেললেও ধিক্কৃত হবে, ক্ষমা চাইবে, অ্যাম্বুল্যান্সে বাড়ি পৌঁছে দেবে। অতএব ‘অণ্ণা তুমি এগিয়ে চলো/ হাম তুম্হারে সাথ হ্যায়’। |
|
বিদ্রোহ! অণ্ণা হজারের সমর্থনে গণবিক্ষোভ। অগস্ট, ২০১১। |
এই নাগরিক মধ্যবিত্ত ‘অপারেশন গ্রিন-হান্ট’-এর বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করেনি। স্মারকলিপি দেওয়া ছাড়া এস ই জেড-এর বিরুদ্ধে, কলিঙ্গনগর কিংবা জগৎসিংহপুরে কর্পোরেট স্বার্থরক্ষায় কৃষকদের উপর পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে রা কাড়েনি। তাতে ঝুঁকি ছিল। সান্ধ্য রাজপথে মোমবাতি জ্বালানোয় তা নেই, বরং তার সমবেত বিচ্ছুরণে বেশ মায়াবী বিভ্রম রচিত হয়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জয় যেমন মশালশোভিত স্টেডিয়ামের দিগ্বিজয়ী বিভ্রমকে দেশময় জাতীয়তাবাদের উজ্জীবনে অনুঘটক করে তোলে। সিনিক শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির সঙ্গে এই সমস্বর অণ্ণা-বন্দনায় অনায়াসে মিশে থাকে অর্ধ-শিক্ষিত বা কু-শিক্ষিত সেই অংশটিও যারা জাতীয় পতাকা হাতে পেলে মসজিদ বা গুরুদ্বার ভাঙতে পারে, সংরক্ষণকে ঘৃণা করে, দুর্জ্ঞেয়বাদী যাবতীয় কুসংস্কারে মজে থাকে। অনশনব্রতী অণ্ণা হজারে ও তাঁর পার্শ্বচরদের তাই আপাতদৃষ্টিতে অরাজনৈতিক নাগরিক সমাজের শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধি মনে হলেও তাঁর ভক্ত-অনুগামীদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে বিরোধী রাজনীতির শিবির।
প্রশ্ন হল, তা বলে কি এই বিরোধিতা ও চ্যালেঞ্জকে অসহিষ্ণুতা ও দমন নীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে? রাস্তায় নেমে নাগরিকদের প্রতিবাদ করাকে ‘ম্যাকার্থিবাদ’, এমনকী নাত্সিবাদের সঙ্গে তুলনা করতে হবে, কংগ্রেস মুখপাত্র মনীশ তিওয়ারি যা করেছেন? অথচ যে ভাবে যোগগুরু রামদেবের সমাবেশে নৈশ অভিযান চালিয়ে নিরস্ত্র মহিলা ও শিশুদের পর্যন্ত নির্মম ভাবে লাঠি-পেটা করা হল এবং অণ্ণা হজারেকে দিনের আলো ফোটার আগেই বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল, সেটাই বরং গেস্টাপোদের পদ্ধতির কথা স্মরণ করায়। ইউ পি এ সরকার যে বিচলিত, ভীত, দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের প্রতি অতি-মাত্রায় স্পর্শকাতর, সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। অণ্ণা হজারেদের ‘রাস্তার আন্দোলন’ বৈধ, গণতান্ত্রিক, প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনপ্রণালীর বিকল্প প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টায় লিপ্ত এই গান ক্রমাগত শোনা যাচ্ছে। আপাতশ্রবণে সুরেই বাজছে এই গান। সত্যিই তো, হজারে বা তাঁর নাগরিক সমাজের বন্ধুরা কারা? কী তাঁদের বৈধতা? তাঁরা কি জনতার নির্বাচিত প্রতিনিধি? পরিষদীয় গণতন্ত্র তো জনপ্রতিনিধিদের দ্বারাই পরিচালিত হবে, আইন প্রণয়নের একচেটিয়া অধিকার তো কেবল আইনসভার? তা হলে সুশীল সমাজের দাবি সরকারকে মানতে হবে কেন? মিডিয়ার যে অংশ অণ্ণার দাবির বিরোধী, তারও অভিমত এ রকমই।
|
পাল্টা প্রশ্ন |
গণতন্ত্র কি কেবল সংসদভবনের গম্ভীর কক্ষের স্তম্ভ আর খিলানে অধিষ্ঠান করে? আজ যাঁরা জনপ্রতিনিধি, তাঁদের বৃহদংশই তো মণ্ডল-উত্তর ‘রাস্তার আন্দোলন’ থেকেই উঠে এসেছেন! অধিকাংশই একটা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর একাংশের, একটি নির্বাচন কেন্দ্রের অর্ধেকেরও কম লোকের সমর্থন পেয়ে আইনসভায়। অণ্ণা হজারের পিছনে যে আসমুদ্রহিমাচল, তা সর্বব্যাপী নয়, সব শ্রেণিকে সমান আন্দোলিতও করছে না। কিন্তু যাদের করছে, ততটা প্রতিনিধিত্বের গৌরবই বা কোন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির আছে? দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত কিছু জনপ্রতিনিধির ভোটে কেবল রাজ্যসভার সদস্য। এ কথা ঠিক যে, অণ্ণা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন, সুশীল সমাজের অন্য নেতারাও নন, তাঁদের কেউ দলীয় টিকিটে প্রার্থীও হননি। কিন্তু তাতে কি তাঁদের প্রতিনিধিত্বের নৈতিকতা এতটুকু হ্রাস পায়? সাংবিধানিক বৈধতা না-থাকতে পারে, কিন্তু নৈতিকতা? পাঁচ বছর অন্তর জনসাধারণ তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পান। এই পাঁচ বছরে দুর্নীতির মতো গুরুতর জাতীয় বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য জানানোর সুযোগ কোথায়, মঞ্চই বা কই? যখন প্রতিনিধিদের ফিরিয়ে আনার (recall) কোনও সংস্থান ভারতীয় গণতন্ত্রে নেই, তখন এই অন্তর্বর্তী সময়ে অণ্ণা হজারের অনশনমঞ্চ কিংবা সুশীল সমাজের আন্দোলনই তো হতে পারে তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ বা দাবিদাওয়া উত্থাপনের বিকল্প পাটাতন! এখন যদি আড়াই বছর পরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা না করে জনসাধারণ অণ্ণার ডাকে সাড়া দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বাড়ি ঘেরাও করে দুর্নীতিবিরোধী বিলের বয়ান আরও কড়া করতে চাপ দেয় (ইতিমধ্যেই যে প্রক্রিয়া অল্পবিস্তর শুরু হয়ে গিয়েছে), তখন কী হবে?
তাই যত সহজে এবং তাচ্ছিল্যভরে জনলোকপাল বিলের দাবি ও আন্দোলনকে ক্ষমতাশীলরা উড়িয়ে দিতে চাইছেন, তত সহজে বিষয়টা না-ও মিটতে পারে। শাসকরা প্রশ্ন করছেন সরকার কি তবে নাগরিক সমাজের কথায় চলবে? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম নাগরিক সমাজের কোনও রকম পরামর্শ নেওয়ারই পক্ষপাতী নন। অথচ ভোটদাতাদের পরামর্শও কি পাঁচ বছর ধরে সরকার নেয়? অতীতে বিশ্ব ব্যাংক বা আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের শর্ত শিরোধার্য করার আগে সরকার কি গণভোট নিয়েছিল? বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউ টি ও) নির্দেশ মানার আগে? নীরা রাডিয়ার রেকর্ড করা কথোপকথন তো বরং ইঙ্গিত করে, টেলিকম মন্ত্রী পদে এ রাজার অভিষেক কর্পোরেট সংস্থার চাপেই। পেট্রোলিয়ম মন্ত্রকে মুরলী দেওরার নিয়োগের পরামর্শও যে বিদেশাগত, উইকিলিক্স-এর উন্মোচনে তারও ইঙ্গিত প্রবল। চিদম্বরম বা তাঁর মতো আরও অনেকের যুক্তি অনুযায়ী, পাঁচ বছর অন্তর জনসাধারণ যে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করছে, সেটাই সরকারের যাবতীয় কাজকর্মের (অপকর্ম সহ) ওপর গণতন্ত্রের সিলমোহর।
কিন্তু সেই জনসাধারণ বা তার উল্লেখযোগ্য অংশ যখন অণ্ণা হজারের পিছনে দাঁড়িয়ে সরকারকে দুর্নীতি দমনে কড়া আইন বানাতে বলে, তখন সরকার সেটাকে গণতন্ত্রের সামনে উপস্থিত চ্যালেঞ্জ বা বিপদ রূপে শনাক্ত করছে। মনে পড়ছে বের্টোল্ট ব্রেখ্টের ‘দ্য সলিউশন’ কবিতার সেই অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা, ১৯৫৩ সালের ১৭ জুন পূর্ব জার্মানিতে সংঘটিত গণ-অসন্তোষের সরকারি প্রতিক্রিয়াকে তীব্র শ্লেষে বিদ্ধ করে যেখানে লেখা হয়েছিল: ‘জনসাধারণ সরকারের আস্থা খুইয়েছে/ তা ফিরে পেতে এখন তাদের দ্বিগুণ চেষ্টা চালাতে হবে/ তার চেয়ে সরকার এই জনসাধারণকে ‘রদ’ করে দিক, ভেঙে দিক/ নতুন এক শ্রেণির জনসাধারণকে নির্বাচিত করে নিক/ তা হলে ব্যাপারটা আরও সহজ হয় না?’ |
|
|
|
|
|