|
|
|
|
প্রবন্ধ ৩... |
বন্যা, দুর্বল বাঁধ সুন্দরবন বিপন্ন |
তুষার কাঞ্জিলাল |
আয়লার পরে সুন্দরবনের এক বিরাট অংশে চাষবাস কিছু হয়নি, জমির কোনও ফসল ঘরে ওঠেনি। এ বারে বর্ষায় চাষটা ভালই হবে এমন একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। এখন সাঁড়াশি আক্রমণ। এক দিকে বন্যা। যাঁরা মাঠের ধানচারা রুইতে পেরেছিলেন, তাঁদের ধানগাছ এক হাত জলের নীচে। এ ভাবে জল দাঁড়িয়ে থাকলে জলের নীচেই সে গাছ পচবে। অন্য দিকে নদীর জল দ্বীপের চার দিকে বাঁধ ছুঁই-ছুঁই অবস্থা। পূর্ণিমার ভরা কোটাল। যাকে আমরা বলি ষাঁড়াষাঁড়ির কোটাল। এই কোটালে এবং অমাবস্যার কোটালে বাড়তি জলের চাপ ভঙ্গুর বাঁধ সইতে পারে না। তাই নোনা জলের প্লাবন ধানখেত, পুকুর, ডোবা, মাঠ সব ভাসিয়ে দেয় এবং মাটির কাঁচা দেওয়ালের বাড়ি ধসে পড়ে। যেখানে বাঁধ ভাঙে না, সেখানেও বাঁধ উপচে নদীর জল ঢুকে পড়ে। ঠিক এই অবস্থায় একে প্রতিরোধ করার সুযোগ কম।
মানুষ দু’ভাবে নিজেরা চেষ্টা করেন। যেহেতু সুন্দরবনের নিকাশি ব্যবস্থা করুণ, তাই মানুষ ফসল বাঁচানোর জন্য নদীবাঁধ কেটে জমা জল বার করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাতে পরে অন্য ধরনের ক্ষতি হয়। দ্বিতীয়ত, মানুষ নিজেরাই পাশের জমি থেকে মাটি কেটে তা-ই দিয়ে জল ঢোকার পথ বন্ধ করতে চেষ্টা করেন।
এ বারে বিপদটা অন্য। আয়লার পর সুন্দরবনের অনেক দ্বীপ থেকেই জোয়ানমদ্দরা বাঁচার তাগিদে সুন্দরবন ছেড়ে দেশময় ছড়িয়ে পড়েছেন, তাই বাঁধে মাটি দেওয়ার সক্ষম লোকের অভাব সর্বত্র। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কিশোর-কিশোরীরা যাঁরা গ্রামে আছেন, তাঁদের দিয়ে এ জলস্রোতকে বাধা দেওয়া যাবে না। সেচ দফতরেরও এ মুহূর্তে করার খুব বেশি কিছু থাকে না। সেচ দফতরের নিজস্ব এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কর্মিবাহিনী নেই। তাদের ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজটা করতে হয়। প্রশাসনিক রীতি মেনে ঠিকাদার ঠিক করে কাজটা শুরু করা সময়সাপেক্ষ। তবুও আপৎকালীন অবস্থায় তাঁরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতে সর্বনাশ ঠেকানো যায় না। এই অবস্থাটা সুন্দরবনে নতুন নয়। প্রায় প্রতি বছরই শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে এই রকম একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়।
সুন্দরবনের নদীবাঁধের মোট আয়তন ৩৫০০ কিলোমিটার। আয়লায় তার ৭৭৮ কিলোমিটার প্রায় ধ্বংস, বাকি অংশগুলিও অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় টিকে আছে। ঝড় এবং বন্যা আটকাবার ক্ষমতা এই বাঁধের নেই। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে সেচ দফতরকে যতটুকু আর্থিক এবং কারিগরি জ্ঞান তাদের কাছে আছে, সেটা নিয়ে গ্রামের মানুষের সহযোগিতা বর্তমানে সর্বনাশকে যতটুকু ঠেকানো যায় তার চেষ্টা করতে হবে।
আসল কাজটা বোধহয় তার পর থেকে শুরু। যতটুকু জানা আছে, আয়লার পরে কেন্দ্রীয় সরকার সুন্দরবনের নদীবাঁধের প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং এই ধরনের ক্ষয়ক্ষতির প্রতিরোধে সক্ষম একটু শক্তপোক্ত বাঁধ গড়ার উপায় নির্ধারণের জন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিলেন। সেই টাস্ক ফোর্স নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বিশদ তথ্য এবং তিনটি ধাপে কী করা যেতে পারে তা প্রস্তাব আকারে দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার এই খাতে ৫০৩০ কোটি টাকা মঞ্জুরও করেছেন। তাতে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, এই দ্বিতীয় ধাপের সঙ্গে সঙ্গে বাঁধের পুনর্নির্মাণ প্রয়োজন। তাতে সম্ভাব্য প্রায় ধরা হয়েছিল ১৪,০০০ হাজার কোটি টাকা। এই টাকাটার সংস্থান কোথা থেকে হবে, তা নির্দিষ্ট করে তাঁরা বলতে পারেননি। বাস্তব সত্য হচ্ছে, যে কোনও কারণেই হোক, টাস্ক ফোর্স-এর প্রস্তাবিত সময়সীমা অনুযায়ী পরিকল্পিত ভাবে এই কাজটা শুরুই হয়নি। আমার মনে হয়, পশ্চিম বাংলায় নতুন সরকার তাঁরা গুরুত্ব দিয়ে এ সব ব্যাপারগুলি ভাববেন এবং দীর্ঘস্থায়ী কাজগুলি পরিকল্পনা অনুযায়ী শুরু করবেন।
আর একটি কথা। অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে যে, আমাদের রাজ্যে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থাটা এখনও গড়ে ওঠেনি। প্রাক্-বিপর্যয়কালীন কিছু ব্যবস্থা এবং বিপর্যয় ঘটে গেলে এবং তার পরে যে ব্যবস্থাগুলি সাধারণত নেওয়া হয়, তাতে সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত এবং দুঃস্থ মানুষদের খুব একটা সমস্যার সমাধান হয় না। যেটার অভাব সবচেয়ে বেশি, তা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং বেসরকারি যে ত্রাণ বা অন্যান্য সাহায্যের সুষ্ঠু বণ্টনের অভাব। এ ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি প্রচেষ্টায় একটা সমন্বয় ঘটিয়ে কাজটা করতে পারলে অনেক বেশি কার্যকর হওয়া সম্ভব।
|
লেখক সুন্দরবন-বিশেষজ্ঞ |
|
|
|
|
|