|
|
|
|
আজ জঙ্গলমহলে মমতা |
পাহাড়-জঙ্গল মিটিয়ে ‘ব্রিগেড-বার্তা’ই লক্ষ্য |
অনিন্দ্য জানা • কলকাতা |
ইতিহাস বলছে, প্রতি বছরের মতোই ‘শহিদ দিবস’। দলের নেতা-সমর্থকদের একাংশ বলছেন, বিধানসভা ভোটে বিপুল জয়ের ‘বিজয়োৎসব’। তিনি নিজে বলছেন, সাধারণ মানুষকে ‘ধন্যবাদ জ্ঞাপনে’র সভা।
আপাতদৃষ্টিতে এই তিন অভিধাই ঠিক। কিন্তু ২০১১ সালের একুশে জুলাইয়ের সভা আসলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের দু’মাসের রিপোর্ট-কার্ড পেশ করার মঞ্চও বটে। যে মঞ্চ থেকে তিনি জানাতে চান, জঙ্গলমহল এবং পাহাড় এ রাজ্যের দু’টি বৃহত্তম সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে তাঁর সরকার! ক্ষমতায় আসার অব্যববহিত পরেই মমতা বলেছিলেন, তিনমাসের মধ্যেই পাহাড় এবং জঙ্গলের সমস্যা মেটাবেন। তিনি যে দু’মাসের মধ্যেই (মমতা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন গত ২০ মে) ওই দুই সমস্যা মিটিয়ে দিয়েছেন, সেই ‘বার্তা’ তিনি দিতে চান ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে। সে জন্যই একুশে জুলাইয়ের অব্যবহিত আগে প্রায় গায়ে গায়ে তাঁর দু’টি সফর। প্রথমে জঙ্গলমহল। তারপর পাহাড়। |
|
মুখ্যমন্ত্রীর সফরের আগে নিরাপত্তা তল্লাশি। সোমবার, মেদিনীপুরে কংসাবতী সেতুর কাছে। রামপ্রসাদ সাউ |
১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই যুব কংগ্রেসের মহাকরণ অবরোধ কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে কলকাতার রাজপথে নিহত হয়েছিলেন ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মী। তারপর থেকে প্রতি বছরই ওই দিনটি ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকেন মমতা। গত ১৮ বছরে মমতার রাজনৈতিক যাত্রাপথ প্রায় নাগরদোলার মতো ওঠানামা করেছে। যার মধ্যে যেমন রয়েছে এনডিএ আমলে রেলমন্ত্রী হওয়া, তেমনই রয়েছে ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে সিপিএমের কাছে পর্যূদস্ত হওয়া। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই রাজ্য-রাজনীতিতে নিজের ‘প্রাসঙ্গিকতা’ ধরে রাখতে পেরেছিলেন মমতা। আর ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকেই রাজ্য-রাজনীতিতে তাঁর লেখচিত্র ঊর্ধ্বমুখী। পঞ্চায়েত ভোটের পর থেকে রাজ্যে বিভিন্ন পুরসভা, উপ নির্বাচনে সাফল্য এবং লোকসভা ভোটে নজিরবিহীন সাফল্য পেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে শেষপর্যন্ত রাজ্যে ৩৪ বছরের কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটাতে পেরেছেন ২০১১-র বিধানসভায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আসন্ন একুশে জুলাইয়ের সমাবেশে মমতা প্রথম অবতীর্ণ হবেন ‘প্রশাসক’ হিসেবে।
ব্রিগেডের ওই সমাবেশের আগে আগামী শনিবার তৃণমূলের প্রথমসারির জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বৈঠক হবে। বৈঠকটি হওয়ার কথা টাউন হলে। সেখানে উপস্থিত থাকবেন মুখ্যমন্ত্রীও। বৈঠকের আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচিতে অবস্য ব্রিগেড সমাবেশ থাকছে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা যে ওই আলোচনাতেই পর্যবসিত হবে, তা নিয়ে তৃণমূলের নেতাদের মনে কোনও সন্দেহ নেই। দলের এক প্রথমসারির নেতার কথায়, “ব্রিগেড সমাবেশের আগে ওইটিই জনপ্রতিনিধিদের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বৈঠক। সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকায় একুশে জুলাইয়ের সমাবেশ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঠিকমতো সময় দিতে পারেননি। ওই বৈঠকেই মুখ্যমন্ত্রী সমাবেশ নিয়ে তাঁর বক্তব্য বলবেন বলে মনে হয়।”
ইতিমধ্যেই একুশে জুলাইয়ের ঘটনায় এক সদস্যের বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন মমতা। সেটি যদি হয় ‘প্রশাসক’ হিসেবে একুশে জুলাই সংক্রান্ত তাঁর প্রথম পদক্ষেপ, তা হলে দ্বিতীয় এবং অনিবার্য পদক্ষেপ অবশ্যই দল এবং রাজ্যের মানুষের প্রতি তাঁর ‘বার্তা’। গত ১৮ বছর ওই সমাবেশে রাজ্যের প্রধান বিরোধী নেত্রীর যে ‘সুর’ তাঁর বক্তব্যে ছিল, তা থেকে নিশ্চিত ভাবে বেরিয়ে আসতে হবে মমতাকে। দিতে হবে প্রশাসক হিসেবে ‘ইতিবাচক’ বার্তা। বলতে হবে, গত ৩৪ বছরে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন সরকার যা করতে পারেনি, ক্ষমতায় এসে তিনি তা করার চেষ্টা করছেন। বলতে হবে, সিপিএমের আমলে রাজ্যের অর্থভান্ডার তলানিতে ঠেকলেও তিনি সীমিত সাধ্যের মধ্যেই ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা’ নিয়ে রাজ্যের উন্নয়নের কাজে এগোচ্ছেন। সেই নিরিখে জঙ্গলমহল এবং পাহাড়ের সমস্যার সমাধান তাঁর কাছে ‘তুরুপের তাস’ বলে মনে করছেন দলের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, ওই দুই সমস্যার সমাধান রাজ্যের মানুষের কাছে এক ‘সদর্থক বার্তা’ পৌঁছে দেবে।
আজ, মঙ্গলবার এবং আগামী কাল, বুধবার পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে সফরে থাকছেন মুখ্যমন্ত্রী। আগামী ১৮ বা ১৯ তারিখ তিনি যেতে চান দার্জিলিংয়ে। গোর্খাল্যান্ড-সমস্যার সমাধানে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সাক্ষরের ‘আনুষ্ঠানিকতা’ সেরে ফেলতে। রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ অফিসারের কথায়, “চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েই গিয়েছে। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। মুখ্যমন্ত্রী নিজে উপস্থিত থেকে সেটি সম্পন্ন করতে চান।” বস্তুত, পাহাড়-সমস্যা সমাধানের দিনক্ষণ বেছে নেওয়ার পিছনে আরও একটি ‘সাংস্কৃতিক’ কারণও রয়েছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি নেপালি কবি ভানুভক্তের জন্মদিন। মমতা চান, তার কাছাকাছি সময়েই পাহাড় সমস্যার সমাধান করে নেপালি জনসমাজের কাছেও একটি ‘বার্তা’ দিতে। একান্তই কোনও কারণে একুশে জুলাইয়ের আগে পাহাড়-চুক্তি সম্পন্ন না-হলে তার পরেই মমতা পাহাড়ে সফরে যাবেন।
কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁর লক্ষ্য একুশে-পূর্ব কোনও দিনই। মাওবাদীদের ‘রাজনৈতিক মোকাবিলা’ করার পাশাপাশিই জঙ্গলমহলের মানুষের জন্য উন্নয়নের প্যাকেজ ঘোষণা করতে চান মুখ্যমন্ত্রী। মাওবাদীদের প্রতি অস্ত্র সংবরণের বার্তা মমতা আগেও দিয়েছিলেন। কিন্তু তা কেন্দ্রের মন্ত্রী হিসেবে। এবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা সেই বার্তা দিতে চান। জঙ্গলমহলের জন্য উন্নয়নের প্যাকেজ ঘোষণা হবে মঙ্গল এবং বুধবার। পরের সপ্তাহে সোম বা মঙ্গলবার (১৮ বা ১৯ তারিখে) পাহাড়-চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেলে মমতার ব্রিগেড ‘প্রশাসনিক’ দিক থেকেও অন্যরকম ‘তাৎপর্য’ বহন করবে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, একুশে জুলাইয়ের সভা থেকে লক্ষ লক্ষ সমর্থকের সামনে মমতা ঘোষণা করতে চান তাঁর সরকারের ওই দুই ‘সাফল্যে’র কথা। পাশাপাশি নির্দিষ্ট করে দিতে চান সরকারের আগামীর ‘রোডম্যাপ’ও। বস্তুত, একুশে জুলাইয়ের সমাবেশের পর থেকে মমতা অধিকাংশ সময়ই ব্যয় করবেন রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ এক দলীয় নেতার কথায়, “একুশের সভার পর থেকে বেশ কিছুদিন মুখ্যমন্ত্রী শুধু শিল্প নিয়েই বসবেন। তাঁর সঙ্গে বণিকমহলের কথোপকথনের পর শিল্প গড়া নিয়ে বেশকিছু প্রস্তাব ইতিমধ্যেই সরকারের কাছে এসেছে। শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেগুলি নিয়ে টানা আলোচনায় বসার পরিকল্পনা রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর।” বলা বাহুল্য, রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনাও মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গলমহল থেকে নির্বাচিত তৃণমূলের বিধায়কদেরও যে মাওবাদীরা হুমকি দিতে শুরু করেছে, তা-ও মুখ্যমন্ত্রীর অজানা নেই। বিরোধী নেত্রী মমতা জঙ্গলমহলে গিয়ে বলেছিলেন, রক্তপাত চান না। বলেছিলেন, উন্নয়নের মাধ্যমে মন জয় করতে হবে জঙ্গলমহলের মানুষের। তখন মাওবাদীদের প্রশাসনিক মোকাবিলার দায়িত্ব ছিল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। এখন জায়গা বদলে গিয়েছে। দেখার, মুখ্যমন্ত্রী মমতা জঙ্গলমহলে গিয়ে কোন বার্তা দেন। |
|
|
|
|
|