|
|
|
|
শিক্ষায় বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা |
পরীক্ষা ছাড়াই আট ক্লাস পাশ চায় রাজ্য |
নিজস্ব সংবাদদাতা• কলকাতা |
আগেকার বাম সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অর্থাৎ প্রাথমিকে ফেল করানোর প্রথা নেই। রাজ্যের নতুন সরকার এ বার সীমাটা বাড়িয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার কথা ভাবছে।
শুধু তা-ই নয়, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত থাকবে না কোনও ইউনিট টেস্টও। ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষা ঐচ্ছিক করার ভাবনাও রয়েছে রাজ্যের। অর্থাৎ চাইলে কোনও পড়ুয়া কার্যত কোনও পরীক্ষার মুখোমুখি না-হয়েই অষ্টম শ্রেণি পেরিয়ে যেতে পারে। তবে প্রথম শ্রেণি থেকে সব পড়ুয়াকেই ইংরেজিতে কথা বলার (স্পোকেন ইংলিশ) পরীক্ষা দিতে হবে। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সোমবার এ কথা জানিয়ে বলেন, “পড়ুয়াদের পরীক্ষা-ভীতি দূর করার জন্যই এই সব পরিকল্পনা।” প্রবীণ শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসকদের অনেকেই অবশ্য মনে করেন, রাজ্য সরকার এই সিদ্ধান্ত নিলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাঁরা চান, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কমিটি গড়ে বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত যাচাই করা হোক।
পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল না-থাকায় পঠনপাঠনের মান পড়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ জানিয়েছে কোনও কোনও শিক্ষক সংগঠন। সংসদে পাশ হওয়া শিক্ষার অধিকার আইনেও ১৪ বছর পর্যন্ত (অষ্টম শ্রেণি) কোনও ছেলেমেয়েকে ফেল করানো যাবে না বলে জানানো হয়েছে। প্রবীণ শিক্ষকদের অনেকের মতে, রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিরই প্রভাবে। যদিও ওই কেন্দ্রীয় আইন পাশের পরেও স্কুলশিক্ষার মানের আরও অবনতির আশঙ্কায় পূর্বতন বাম সরকার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল রদের কথা ভাবেনি।
ব্রাত্যবাবু এ দিন বলেন, “কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা ঐচ্ছিক করার কথা ভাবা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ভাবা হচ্ছে ইউনিট টেস্ট তুলে দেওয়ার কথাও। কারণ এতে পড়ুয়াদের সমস্যা হচ্ছে। আধিকারিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথাও বলেছি।” শিক্ষামন্ত্রী জানান, পাশ-ফেল প্রথাটারই পুনর্মূল্যায়ন দরকার বলে মনে করছে সরকার। তিনি বলেন, “কোন পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করা যায়, তা ভেবে দেখা দরকার। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।” শিক্ষামন্ত্রী জানান, প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজার কথা ভাবা হচ্ছে। সেই জন্য একটি সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম কমিটিও গড়া হয়েছে।
ছাত্রছাত্রীদের মন থেকে পরীক্ষা-ভীতি কী ভাবে দূর করা যায়, সেই ব্যাপারে মনস্তত্ত্ববিদদের সাহায্য নেওয়া হতে পারে বলেও জানান শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পরীক্ষা না-দিয়ে নবম-দশমের পরীক্ষা দিতে গিয়ে কি ছাত্রছাত্রীরা আরও বেশি ভয় পাবে না? ব্রাত্যবাবু বলেন, “আমার ধারণা, ঐচ্ছিক করা হলেও অধিকাংশ ছেলেমেয়েই পরীক্ষা দেবে। তা ছাড়া আগে পরীক্ষা দেয়নি বলে নবম শ্রেণিতে উঠে কোনও পড়ুয়া পরীক্ষা দিতে ভয় পাবে, এটা আগে থেকে ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই।”
শিক্ষামন্ত্রী জানান, জাতীয় ক্ষেত্রে এ রাজ্যের পড়ুয়াদের ‘এগিয়ে রাখতে’ ইংরেজিতে কথা বলার উপরে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা চালু করতে চান তাঁরা। সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতে প্রথম শ্রেণি থেকে এই পরীক্ষা চালু হবে। প্রশ্ন উঠেছে, যাঁরা ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখাবেন, সেই শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেরাই কি ইংরেজি বলায় যথেষ্ট সড়গড়?
পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়া এবং পরীক্ষা ঐচ্ছিক করার বিরোধিতা করছে অধিকাংশ শিক্ষক সংগঠন। সুনন্দ সান্যাল বলেন, “ব্রাত্যবাবু ঠিক কী বলেছেন, আমি জানি না। তবে যদি পরীক্ষাকে
ঐচ্ছিক করার কথাই বলে থাকেন, তা নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, আমাদের সমাজ পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে পরীক্ষার গুরুত্ব রয়েছে খুবই। বড়দেরও নানা ভাবে পরীক্ষা দিতে হয়।” অনেক শিক্ষকের মতে, ছাত্রের ভীতির জন্য পরীক্ষা তুলে দিলে তো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও পরীক্ষা রদ করতে হয়। কারণ, ওই পর্যায়ের পরীক্ষায় বসতেও পরীক্ষার্থীরা ভয় পেতে পারেন।
অধ্যাপক পবিত্র সরকার মনে করেন, ছেলেমেয়েদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ রাখা উচিত। পরীক্ষাটা সেই চ্যালেঞ্জ। পরীক্ষার মাধ্যমে তারা নিজেদের মূল্যায়ন করতে পারে। অভিভাবকেরাও চান, ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিক। স্কুলে পরীক্ষা উঠে গেলে টিউটোরিয়ালে পরীক্ষা (মক টেস্ট)-র রমরমা আরও বাড়বে। পবিত্রবাবু বলেন, “শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন, তিনি বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করুন। সকলের সঙ্গে আলোচনা করেই যেন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”
অনেক প্রবীণ শিক্ষকের মতে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা তুলে দিলে শুধু স্কুলশিক্ষার মানই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। আইএসআই-এর অধ্যাপক অভিরূপ সরকারের আশঙ্কা, সরকার এই সিদ্ধান্ত নিলে যে-সব স্কুলে পরীক্ষা রয়েছে (দিল্লি বোর্ডের), সেখানে ছেলেমেয়েদের ভিড় বাড়বে। ধনী-গরিবের শিক্ষার মানের মধ্যে ফারাক বাড়বে। তাঁর মন্তব্য,
প্রাথমিকে পরীক্ষা তুলে দেওয়ার ফল খুব ভাল হয়নি। তবে একই সঙ্গে তিনি জানান, পরীক্ষাই ছাত্রকে শেখানোর একমাত্র উপায় কি না, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। তিনি বলেন, “আমি চাইব, রাজ্য
সরকার এই ব্যাপারে কমিটি গড়ুক। সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত নিয়ে সুপারিশ করুক কমিটি। তার পরে সেই সুপারিশের ভিত্তিতে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিক।” |
|
|
|
|
|