|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
স্বাধীন রাষ্ট্র থেকে স্বায়ত্তশাসনের মধ্যপথে |
সাত বছর আগে ধরমশালার দোকানে দোকানে ঝুলত ‘ফ্রি টিবেট’ পোস্টার। এখন অন্য স্বপ্ন। একটা দোকানে
লেখা,‘তিব্বত ফের নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কিন্তু মধ্যপন্থাই শ্রেয়।’ দলাই লামার শিক্ষণশিবির থেকে ফিরে গৌতম চক্রবর্তী |
হঠাৎ দেখলেন, আপনার দিকে একটা ছুরি এগিয়ে আসছে। কী করবেন? ভয়ে আঁতকে সরে যাবেন। সেই ভয় থেকে রাগ হবে লোকটা আমাকে ছুরি দিয়ে মারতে চায়? ছুরিটা কেউ ভালবেসে ফল কাটার জন্যও এগিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আমাদের চেতনা পদে পদে ভ্রান্তি তৈরি করে। সে শিখিয়েছে, ছুরি মানে ধারালো। ছুরি মানে কেটেকুটে রক্তাক্ত হয়ে যাওয়া। কোনও ঘটনায় এই যে নাম ও পরিচিতির লেবেল সেঁটে দেওয়ার মানসিক অভ্যাস এটা ভাল, এটা খারাপ, এ থেকেই যাবতীয় বিভ্রান্তি।
ছুরি এগিয়ে আসা কিছুই নয়, একটা ঘটনামাত্র। আর যে কোনও ঘটনা আসলে শূন্যতা। শূন্যতা মানে? ফাঁপা বা ‘এম্পটিনেস’ নয়। শূন্যতা মানে, এটা ভাল বা ওটা খারাপ এই জাতীয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে না যাওয়া। হ্যাঁ এবং না-এর মাঝে যে সদর্থক নৈঃশব্দ্য, তাকেই বলে শূন্যতা। বৌদ্ধ দর্শন আসলে এই শূন্যতার দর্শন।
আর শূন্যতার এই দর্শন অভ্যাস করলে নাম এবং পরিচিতির একটিমাত্র তকমা আপনাকে আর বিভ্রান্ত করবে না। ধরুন, বাসে বোমা মারতে গিয়ে কেউ ধরা পড়েছে। আমরা কী বলব? লোকটি সন্ত্রাসবাদী। অথচ পারিবারিক জীবনে সে হয়তো ভাল বাবা, ভাল স্বামী। কিন্তু শূন্যতার দৃষ্টি না-থাকায় আমরা নাম এবং পরিচিতির একটিই ধাঁচায় লোকটিকে ফেলে দেব, ‘ও সন্ত্রাসবাদী।’ তার পর বিভ্রান্তি থেকে ক্ষোভ, হিংসার আগুন।
‘পরিচিতি ও হিংসা’ নিয়ে সেমিনার নয়। ম্যাকলিয়ডগঞ্জের দুপুর রোদে এই কথাগুলি বলছিলেন ৭৬ বছরের মুণ্ডিতমস্তক, কাষায় বস্ত্র পরিহিত এক বৌদ্ধ ভিক্ষু। চতুর্দশ দলাই লামা তেনজিন গিয়াতসো। রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়ার পর ভারতে তাঁর প্রথম শিক্ষণশিবির।
|
ক্লাস ২০১১ |
শিবির অবশ্য নতুন নয়। ভারতে থাকলে চতুর্দশ দলাই লামা মাঝে মাঝেই বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে দু’তিন দিন এই ভাবে টানা ক্লাস নেন। এ বার দলাই লামার অফিস থেকে একটি অনুরোধ ছিল। ক্লাসে যোগ দিলে তিন দিন আগে আসুন। জুনের শেষ মঙ্গলবার ক্লাস শুরু। কিন্তু তার আগে শনিবার থেকেই ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ রব। প্রতিটি হোটেল এবং গেস্ট হাউসে উপচে পড়া ভিড়। আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, ভিয়েতনাম... কোত্থেকে লোক আসেনি? স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা হিসাব দিলেন, ক্লাসে যোগ দিতে ৫৩টি দেশ থেকে প্রায় ৫ হাজার লোক নাম রেজিস্ট্রি করেছে। এই পাঁচ হাজারের আড়াই হাজার-ই তিব্বতি। লে, লাদাখ, লাহুল, স্পিতি, দার্জিলিং থেকে মহীশূর... কোনও জায়গা বাকি নেই।
সকাল ৯টা থেকে ক্লাস। নিতে হয়েছে বসার আসন, একটি কাপ ও এফএম রেডিয়ো। ক্লাসে পদ্মাসনে বসতে হবে, নিয়ম। সঙ্গের পেয়ালায় স্বেচ্ছাসেবকরা মাঝে মাঝে এসে মাখন-চা ঢেলে দেবেন। আর এফ এম রেডিয়ো? চতুর্দশ দলাই লামা তিব্বতিতে বক্তৃতা দেন। দশ মিনিট পরে থামেন। তার পরেই এফ এম-অনুবাদ। একটি তরঙ্গে ইংরেজি, একটিতে স্প্যানিশ, একটিতে কোরিয়ান। আর একটিতে চিনা অনুবাদ। দলাই লামার বক্তৃতার চিনা অনুবাদ? স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তা ঠাহর করিয়ে দিলেন, চিনা ভাষা শুধুই লাল চিনের দখলদারি নয়। সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান সর্বত্র ওই ভাষা।
|
ধরমশালা এখন |
সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা অবধি এফ এমের নব ঘোরানো। ঠায় পদ্মাসনে বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঁঝি ধরে যাওয়া! “সব ধর্মই যন্ত্রণা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে চেয়েছে। কিন্তু অন্যরা ঈশ্বরের কথা বলেন। বৌদ্ধ দর্শন শূন্যতার কথা বলে,” বলে যাচ্ছেন দলাই লামা।
সবই শূন্যতা? ধরমশালায় এখন উইক-এন্ডে পঞ্জাব, হরিয়ানা থেকে উপচে-পড়া ভিড়। ভাঙাচোরা রাস্তা। তার মধ্যেই ডিস্কো, লাউঞ্জ বার থেকে ক্যাফে, সকলে আলোর মালায় সেজে হাজির। তিব্বতি পটচিত্র (থাঙ্কা), কিউরিয়ো আর পাথরের গয়নার বর্ণাঢ্য সব দোকান।
তফাত একটাই। সাত বছর আগে দোকানে দোকানে ঝুলত ‘ফ্রি টিবেট’ পোস্টার। এখন অন্য স্বপ্ন। একটা দোকানে লেখা, ‘তিব্বত ফের নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কিন্তু মধ্যপন্থাই শ্রেয়।’ মধ্যপন্থা মানে? আলাদা রাষ্ট্র নয়, চিনের অধীনেই স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন দেখেন দলাই লামারা।
মধ্যপন্থায় লাভ? প্রশ্ন করেছিলাম তেনজিন ডোনিয়োকে। তেনজিন ধরমশালায় একটি ইতালীয় কাফে চালান, সম্পর্কে নতুন তিব্বতি প্রধানমন্ত্রী লোবসাং সাঙ্গের ভাই। তেনজিন হাসলেন, “আগে দিল্লির চিনা দূতাবাসে প্রতিবাদ জানাতে গেলে ওরা ঢুকতে দিত না। এখন চা, কফি খাইয়ে বলে, না, সম্ভব নয়। তবে আলোচনার টেবিলে তো বসা যায়!” |
|
ভারতে বেড়ে-ওঠা দ্বিতীয় প্রজন্মের তিব্বতিরা বেশির ভাগ তেনজিনেরই মতো। অর্থনীতির মই বেয়ে মধ্যবিত্ত হতে চায়। পাবে এক বিকেলে আলাপ সুন্দরী ডেকির সঙ্গে। ডেকির বাবা ’৫৯ সালে দলাই লামার সঙ্গে এ দেশে চলে এসেছিলেন। সেই মেয়ে এখন ধরমশালার এক রফতানি-সংস্থায় চাকরি করে। কলোরাডো উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। তার দিদি সেখানে এক হাসপাতালের সেবিকা। “আমার নামের মানে জানো? হ্যাপিনেস। দেখো, সুখ আমি খুঁজে পাবই,” ফিসফিস করে বলেছিল ডেকি।
সুখ মানে? আগে ধরমশালার দোকানে স্টিকার সাঁটা থাকত, ‘চিনা জিনিস আমরা বিক্রি করি না।’ এখন দোকানে দোকানে সস্তা চিনা টর্চ, ছাতা আর অন্যান্য জিনিস। তিব্বতি থুকপা, মোমোর পাশাপাশি ফ্রায়েড রাইস, চাউমিন, সেচুয়ান চিকেনের অজস্র রেস্তোরাঁ। স্বাধীন তিব্বতের দাবি ছেড়ে মধ্যপন্থায় আসা ছাড়া চতুর্দশ দলাই লামার গত্যন্তর ছিল না।
ট্র্যাজেডি অন্যত্র। বছর দশেক আগে দলাই লামার অফিসের কাছে ‘টিবেট মিউজিয়ম’ খোলা হয়েছে। ’৫৯ সালে দলাই লামার পালিয়ে-আসার দুষ্প্রাপ্য ছবি থেকে চিনা ইলেকট্রিক ব্যাটন, হাতকড়া ইত্যাদি নানা নির্যাতন-সরঞ্জাম সেখানে রাখা। জাদুঘরে সবচেয়ে কমবয়সী কিউরেটর ৪০ বছর বয়সের এক ভিক্ষুণী। নাম রিনজিন চোঙ্গি। ১৯৯৭-এ পালিয়ে এসেছেন তিনি। রয়েছেন ৪২ বছরের জাম্পেল মোনলাম। দু’জনেরই জন্ম দলাই লামা চলে আসার দেড়-দুই দশক পর। দু’জনেই কৃষক পরিবারের। মাও জে দং বলেছিলেন, তিব্বতের কৃষককে সামন্তশাসন থেকে মুক্তি দিতেই বিপ্লব। তার পরেও এই অবস্থা? দ্বিতীয় প্রজন্মের নির্বাসিত তিব্বতিরা মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে। চিনের তিব্বতি কৃষক পরিবার সেই স্বপ্নও দেখতে পারে না।
|
নালন্দার দিকে |
আড়াই দিনের পঠন শেষ করে উঠে বসেছি দিল্লির বাসে। সঙ্গীরা বেশির ভাগই ভিয়েতনাম ও কোরিয়ার। অনেকেই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৌদ্ধ দর্শনের ছাত্র। ‘এত দূর থেকে দিল্লিতে পড়তে আসেন?’ শুনেই তাঁরা হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “না না, আমরা এমএ পড়ছি। নালন্দায় এমফিল করব। ২০১৩ সালেই খুলে যাবে, না?” ভিয়েতনাম, কোরিয়া থেকে আসা এত ছাত্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বপ্ন দেখেন? কলকাতায় এখন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান, পঠনপাঠন নিয়ে অজস্র জল্পনা। কিন্তু নালন্দার কথা আমাদের খেয়াল থাকে না।
শিক্ষা সম্পর্কে দলাই লামা তাঁর ক্লাসে এক দিন বলছিলেন, “লক্ষ করে দেখবেন, শাক্যমুনি বুদ্ধ কোনও দিন নিজেকে ঈশ্বর বলেননি। গুরু বলেননি। বরং বলেছেন, আমি জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছি। নিজেকে শিক্ষক বলেছেন।” বুদ্ধের দেশ শিক্ষায় সত্যিই সাড়া জাগাতে পারে কি না, নালন্দাই হতে চলেছে তার আধুনিক প্রমাণ! কে জানত, এই বৌদ্ধ ট্রিপে এটাই ছিল ঝাঁকিদর্শন! |
|
|
|
|
|