আশপাশের গ্রামবাসীরা তাঁদের উদ্ধার না করলে গুয়াহাটি-পুরী এক্সপ্রেসের ‘মৃতের’ তালিকা তৈরি করতে হত উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের কর্তাদের। রঙ্গিয়ার ভাতকুচির কাছে ভয়াবহ বিস্ফোরণে রেল লাইন থেকে ছিটকে পড়া কামরাগুলির যাত্রীরা তাই কৃতজ্ঞ ওই মানুষগুলির কাছে। কানপুরে কালকা মেলের দুর্ঘটনা ও মৃত্যু-মিছিলের খবর জানার পর অসমে দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনটির যাত্রীরা এখনও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। কেউ কেউ ট্রেন দুর্ঘটনার কথা মনেই করতে চাইছেন না।
গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পূর্ণিমা গগৈ প্রাণে বাঁচার জন্য জগন্নাথকেই ধন্যবাদ দিচ্ছেন। কলেজ ছাত্রী পূর্ণিমা বাবা-মায়ের সঙ্গে পুরী যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এই দুর্ঘটনা। ‘আশ্চর্য রকম ভাবে প্রাণে বেঁচে যাওয়া’ পূর্ণিমা তাই ওই ঘটনার কথা মনেই করতে চাইছেন না। নাছোড় সাংবাদিকদের কাছে পূর্ণিমার কাতর আর্জি, “আমায় কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। আমি কাল রাতের কথা আর মনে করতে চাইছি না।”
রবিবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ হঠাৎ এক কান ফাটানো আওয়াজ এবং তার পরেই রেল থেকে ইঞ্জিন-সহ আটটি কামরার ছিটকে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে এখনও কেঁপে কেঁপে উঠছেন উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের অনেকেই। পাশের নয়ানজুলিতে কাত হয়ে পড়েছিল তিনটি বগি। তার যাত্রীদের কথায়, “সাধারণ গ্রামবাসীরা না থাকলে তো আমরা ডুবেই মারা যেতাম।” তাঁদের ক্ষোভ, রেলের লোকজন বা পুলিশ প্রথম কয়েক ঘন্টায় এদের কারও দেখাই মেলেনি। গ্রামবাসী যুবকরা ট্রেন থেকে এক এক করে যাত্রীদের বের করে এনে মোটরবাইকে চাপিয়ে পৌঁছেছে কাছাকাছি সড়কে। তারপর সেখান থেকেই আহতদের পাঠানো হয়েছে হাসপাতালে। |
কামরূপের রঙ্গিয়ার কাছে পড়ে রয়েছে বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত রেললাইন থেকে ছিটকে
যাওয়া গুয়াহাটি-পুরী এক্সপ্রেসের কামরা। সোমবার উজ্জ্বল দেবের তোলা ছবি। |
এ দিকে, পুলিশের প্রাথমিক সন্দেহ ছিল, বড়ো জঙ্গিরাই এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই আদিবাসী পিপল্স আর্মি (আপা) বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করে একটি সংবাদমাধ্যমে ফোন করে। আপা-র দাবিতে পুলিশও খানিকটা বিভ্রান্ত। এই দাবি কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা নিয়ে পুলিশের একাংশের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। যদিও পুলিশ তাদের দাবি একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছে না। গোয়েন্দাবিভাগের এক বড়কর্তার কথায়, “কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে যে বোমা উদ্ধার হয়েছিল সেটির পিছনে ‘আপা’-র হাত ছিল। সে বার বিফল হলেও, মনে হচ্ছে একই ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করতে এ বার তারা সফল।” আলফার পরেশপন্থীরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে। মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেন, “এমন বর্বর ঘটনা অত্যন্ত নিন্দার। সাধারণ নাগরিকদের মেরে কোনও উদ্দেশ্য সাধিত হয় না।” ঘটনার জেরে রাজ্য জুড়ে উচ্চ-সতর্কতা জারি করা হয়েছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী তল্লাশি জোরদার করেছে।” মুখ্যমন্ত্রী জানান, বিস্ফোরণে ব্যবহৃত তার ও অন্যান্য সামগ্রী উদ্ধার হয়েছে। ঘটনার পিছনে কারা রয়েছে তা নিশ্চিত নয়। কী ধরণের বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়েছে তা ফরেনসিক পরীক্ষার পরেই জানা যাবে।
ঘটনার পরেই রেলওয়ে সেফটি কমিশনার তদন্ত শুরু করেছে। দশ দিনের মধ্যে কমিশনার বলবীর সিংহ তাঁর রিপোর্ট জমা দেবেন। এ দিকে, দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের সচিব ইউ কে বনসল বলেন, “এনডিএফবি রেলে নাশকতা করতে পারে বলে গত তিন মাসে বেশ কয়েকবার গোয়েন্দা রিপোর্ট এসেছে। তার ভিত্তিতে রাজ্য সরকারকে আগাম সতর্কও করা হয়েছিল।” বনশল জানান, তবে এনডিএফবি-র জনসংযোগ সচিব বি সানজো বিস্ফোরণের দায় অস্বীকার করেছে। বনসল জানান, ‘আদিবাসী পিপল্স আর্মি’-র এক স্বঘোষিত কম্যান্ডার সিলভিয়া ওরাং একটি ই-মেলটি পাঠিয়ে দায় স্বীকার করেছে। সে সোরেন নামেও পরিচিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য, রঙ্গিয়ায় রেললাইনে বিস্ফোরণের দোষীদের পাকড়াও করতে সমস্ত রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রকে অসম সরকার জানিয়েছে।
উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের জনসংযোগ আধিকারিক জয়ন্ত শর্মা জানিয়েছেন, রেলপথের ক্ষতি হওয়ায় মানস-রাইনো এক্সপ্রেস, নিউ বঙ্গাইগাঁও প্যাসেঞ্জার, আলিপুরদুয়ার-কামাখ্য ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস, লামডিং-আলিপুরদুয়ার ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস, সিফুং প্যাসেঞ্জার, গুয়াহাটি-হয়বরগাঁও প্যাসেঞ্জার ট্রেন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। বাকি ট্রেনগুলি আজারা-গোয়ালপাড়া-নিউ বঙাইগাঁও হয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উত্তর-পূর্ব রেল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গত কালের ঘটনায় আশঙ্কাজনক অবস্থা তিন জনের। ২৩ জন জখম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। সামান্য জখম হয়েছেন ১৩ জন। কাল বিস্ফোরণের পরে অক্ষত কামরাগুলিকে যাত্রী-সহ গুয়াহাটি নিয়ে আশা হয়। এরপর নতুন ৮টি কামরা যোগ করে, সুস্থ ও ইচ্ছুক যাত্রীদের নিয়ে ভোর ৪টে নাগাদ ট্রেনটি পুরীর উদ্দেশে রওনা দেয়। |