উনুন চড়েনি। ঘরদোর অগোছালো। ছাড়া জামাকাপড় এলোমেলো হয়ে পড়ে। একতলার ঘরের দরজা ভেজিয়ে বাড়ির সকলেই চলে এসেছেন বাইরে।
সোমবার সকাল ৮টায় হঠাৎই যেন সংসার থমকে গিয়েছে মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামের ভালকুণ্ডি গ্রামে। তখনই খবর আসে, তাঁদের বাড়ির উৎপল মণ্ডল (৩৪) কালকা মেলের দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। খবর দেন উৎপলবাবুর ভাই নির্মল। দিল্লিতে তাঁর কাছে যাচ্ছিলেন উৎপলবাবু।
কালকা মেলের দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে হুগলির ভদ্রেশ্বরের মহম্মদ সাজ্জাদ (১৩) এবং আসানসোল রেলপাড়ের বাসিন্দা মহম্মদ সাগিরকেও (১৬)। রাত পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি আরও অনেকের। শনিবার বর্ধমান স্টেশন থেকে ওই অভিশপ্ত ট্রেনে উঠেছিলেন ৭১ জন যাত্রী। যে এস-১ এবং এস-২ কামরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে দু’টিতে ছিলেন মোট ২২ জন। বিকেল পর্যন্ত সাত জন যাত্রীর আহত হওয়ার খবর রেল সূত্রে জানানো হয়েছে। |
মৃত সাকিনা বিবি ও তাঁর ছেলে সাজ্জাদ |
কিন্তু কারও মৃত্যুর খবর মেলেনি। বাড়ির লোকজন খোঁজখবর করে বেড়াচ্ছেন।
প্রায় এক মাস কলকাতায় কাটিয়ে বাবা-মা মহম্মদ সুলেমান ও সাকিনা বিবির সঙ্গে দিল্লি ফিরছিলেন সাজ্জাদ ও তাঁর দিদি শবনম। সুলেমান দিল্লির ভোগালে নিজামুদ্দিন মসজিদে কাজ করেন। দুর্ঘটনার পরে শবনম এবং সুলেমানের খোঁজ মিললেও সাকিনা বিবি এবং সাজ্জাদ নিখোঁজ ছিলেন। পরে রেলের তরফে মৃতদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, তাতে মহম্মদ সাজ্জাদের নাম রয়েছে। ফোনে শবনম বলেন, “মা ও ভাইয়ের দেহ শনাক্ত করেছি। ফতেপুর জেলা হাসপাতালে দু’টি দেহেরই ময়না-তদন্ত হয়েছে।” সাকিনা বিবির দাদা মহম্মদ ওসমান আনসারি, সুলেমানের দাদা মহম্মদ সেলিম দুই প্রতিবেশীকে নিয়ে বিশেষ ট্রেনে মালওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।
চাকরির খোঁজে পড়শি কয়েক জন যুবকের সঙ্গে আলিগড় যাচ্ছিল আসানসোলের রেলপাড় অঞ্চলের আজাদ বস্তির মহম্মদ সাগির। তার সঙ্গীদের অবস্থা কিন্তু জানা যায়নি। ভাই মহম্মদ সাবির জানান, রবিবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ শেষ বার মোবাইলে দাদার সঙ্গে কথা হয়েছিল। পাড়ার কয়েক জন যুবক হরিদ্বার এক্সপ্রেস ধরে দুর্ঘটনাস্থলে চলে গিয়েছেন। |
রবিবার রাতে বাবা দয়ানন্দ সিংহের খোঁজে রওনা হয়েছেন হিরাপুরের নরসিংহ বাঁধ এলাকার মুঙ্গেরিয়া খাটালের বাসিন্দা ভূপেশ সিংহ। উত্তরপ্রদেশে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাবেন বলে ওই ট্রেনে চেপেছিলেন দয়ানন্দ সিংহ (৬৮)। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বারবার তাঁর মোবাইলে ফোন করছিলেন বাড়ির লোকজন। প্রথমে ফোন বেজে যাচ্ছিল, পরে তা-ও বন্ধ হয়ে যায়। রেল সূত্রে প্রথম ৩৫ জনের তালিকায় নাম না থাকলেও সোমবার দুর্ঘটনাস্থল থেকে ফোনে ভূপেশ বলেন, “বাবার দেহ শনাক্ত করেছি। দেহে ৪৪ নম্বর টিকিট সেঁটে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় হাসপাতালে ময়না তদন্তের পরে দেহ নিয়ে ফিরব।” দয়ানন্দবাবুর স্ত্রীকে অবশ্য সে খবর দেওয়া হয়নি।
খড়গ্রামের উৎপলবাবু গ্যাসের পাইপ সারানোর কাজ করতেন। বেশ কয়েক বার কলকাতা, ওড়িশা গিয়েছেন। এ বার ঠিক করেছিলেন ভাইয়ের কাছে থেকে কাজ করবেন। তাঁর স্ত্রী সঞ্চিতা মণ্ডল বলেন, “অনেক বার বারণ করেছিলাম অত দূরে যেতে। কিন্তু শুনলেন না।” |
নির্মলবাবু বলেন, “দাদা কিছুতেই ফোন তুলছে না দেখেই সন্দেহ হয়। দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, উনি আর নেই।” গ্রামের অনেকেই কর্মসূত্রে দিল্লি বা অন্যত্র থাকেন। তাঁদের কয়েক জন ওই ট্রেনে উৎপলবাবুর সঙ্গেই ছিলেন। কয়েক জনের আহত হওয়ার খবর গ্রামে এসেছে। সেই সব বাড়িতেও দুশ্চিন্তার প্রহর গোনা চলছে। পাশাপাশি, উৎপলবাবুর পরিবারকেও আগলে রেখেছেন তাঁরা। “রবিবার ভোরে ওঁর সঙ্গে শেষ বার ফোনে কথা হয়। জোর দিয়ে বলেছিল ছেলেগুলোর দিকে নজর রেখো” বলতে বলতে সঞ্চিতাদেবী ফের কান্নায় ভেঙে পড়েন। |