রেল দুর্ঘটনাস্থলে রেল প্রতিমন্ত্রী মুকুল রায়ের না-যাওয়া নিয়ে বিতর্ক বাধল।
অসমের রঙ্গিয়ায় রবিবার রাতে গুয়াহাটি-পুরী এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ার খবর আসার পরে মুকুলবাবুকে ‘প্রয়োজনে’ ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। পূর্ণমন্ত্রী না-থাকায় রেল মন্ত্রক এখন প্রধামন্ত্রীর হাতেই রয়েছে। কিন্তু সোমবার মুকুলবাবু অসমে দুর্ঘটনাস্থলে না-গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ‘উপেক্ষা’ করেছেন কি না, এই নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে রাজনৈতিক শিবির। দেশের প্রধান বিরোধী দল সরাসরিই বলেছে, প্রধানমন্ত্রী এখন এমনই ‘অসহায়’ যে, তিনি নির্দেশ দিলেও এক জন প্রতিমন্ত্রী তা ‘অবজ্ঞা’ করেন! মুকুলবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, তিনি ঘটনাস্থলে যেতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলওয়ের তরফে তাঁকে জানানো হয়, পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই নিয়ন্ত্রণে। মন্ত্রীর আসার ‘প্রয়োজন’ নেই। কেন তিনি যাননি, সেই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে তিনি ‘নোট’ পাঠিয়েছেন বলে জানান মুকুলবাবু।
অল্প সময়ের ব্যবধানে পর পর দু’টি রেল দুর্ঘটনায় যথেষ্টই ‘বিব্রত’ রেল প্রশাসন এবং সার্বিক ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে রেলমন্ত্রী হিসাবে ইস্তফা দেওয়ার পরে যে হেতু মন্ত্রকে কোনও পূর্ণমন্ত্রী নেই, তাই
বষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক জলঘোলাও বেশি হচ্ছে। ঘটনাচক্রে, আজ, মঙ্গলবারই তৃণমূলের তরফে রেলের পূর্ণমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার কথা। রবিবার রঙ্গিয়ার ঘটনার পরে মুকুলবাবুকে ফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ফতেপুর এবং রঙ্গিয়া, দু’টি ঘটনা নিয়েই তাঁদের মধ্যে কথা হয়। তার পরে এ দিন সকালে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘অসমে রেল দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী রেল প্রতিমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন’।
এর পরেও মুকুলবাবু শেষ পর্যন্ত ঘটনাস্থলে না-যাওয়ায় বিতর্ক দানা বাঁধে। কংগ্রেস নেতৃত্বও গোটা ঘটনায় ঈষৎ ‘অসন্তুষ্ট’ বলে দলীয় সূত্রের খবর। মুকুলবাবু অবশ্য বলেছেন, “রবিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন। অসমে রেললাইনে যে একটি বিস্ফোরণ হয়েছে এবং তার জেরেই ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছে বলে প্রাথমিক রিপোর্টের কথা তখনই তাঁকে জানাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে ঘটনাস্থলে যেতে।” রেলের প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে মুকুলবাবুই অসমের ঘটনাস্থল থেকে তুলনায় কাছাকাছি ছিলেন। মুকুলবাবুর বক্তব্য, “উত্তর-পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজারকে আমি বলি, সোমবার সকালে গিয়ে বিকালে ফিরে আসতে চাই। কিন্তু উনি আমাকে বলেন, আসার দরকার নেই। কয়েক জন গুরুতর আহত। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু কোনও জীবনের আশঙ্কা নেই। রেললাইন পরিষ্কারের কাজও চলছে। এই গোটা ব্যাপারটা আমি প্রধানমন্ত্রীকে নোট দিয়ে জানিয়েছি। গোটা পরিস্থিতিই সেই নোটে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।”
উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের জেনারেল ম্যানেজার এম আর চন্দ্রও ঘটনা সম্পর্কে একই কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, “রঙ্গিয়ায় ঘটনাস্থলে আসতে চেয়েছিলেন মন্ত্রী। কিন্তু আমরা তাঁকে বলি, পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক এবং কোনও মৃত্যুর আশঙ্কা নেই।” উদ্ধারপর্ব সেরে ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টার মধ্যে রেললাইন ফের ট্রেন চলাচলের উপযুক্ত করে তোলা যাবে বলে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের তরফে মুকুলবাবুকে জানানো হয়। চন্দ্রই সে কথা জানিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা যা-ই হোক, ইউপিএ সরকার এবং ‘দুর্বল’ প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি বিরোধীরা। বিজেপি-র মুখপাত্র জগৎ প্রকাশ নাড্ডা যেমন বলেছেন, “জোটধর্মের বাধ্যবাধকতার দোহাই বারবার দিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, সাধারণ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী জোটধর্ম বজায় রাখছেন!” বিজেপি-র অভিযোগ, মমতা রেলমন্ত্রী থাকার সময়ে তিনি গোটা রেলবোর্ডকে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তা আটকাতে পারেননি। রেলের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে কোনও মনোযোগ দেওয়া হয়নি। এখন নিজে রেলের দায়িত্বে থাকলেও তার দিকে নজর দেননি প্রধানমন্ত্রী। নাড্ডার বক্তব্য, “এই ‘কালো রবিবার’-এর পরেও রেলের প্রতিমন্ত্রী মুকুলবাবু ঘটনাস্থলে যাননি। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে তাঁকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দিতে হয়। কিন্তু তার পরেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অবজ্ঞা করেন তাঁর মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী তো রীতিমতো অসহায়!” ফতেপুরের দুর্ঘটনার পরেও রবিবার মুকুলবাবু বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলে তবেই তিনি দুর্ঘটনাস্থলে যাবেন। এই প্রেক্ষিতে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি মন্তব্য করেছেন, “এমন পরিস্থিতি যে, কেউই দুর্ঘটনার দায় নিতে রাজি নন! এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, রেল মন্ত্রক কী ভাবে চলছে!”
উত্তরপ্রদেশের ফতেপুরে কালকা মেলের দুর্ঘটনাস্থলে না-যাওয়ার ব্যাপারেও মুকুলবাবু বলেছিলেন, ‘প্রয়োজন’ হলে তবেই তিনি সেখানে যাবেন। তা ছাড়া, তিনি ঘটনাস্থল থেকে ‘হাজার কিলোমিটার দূরে’ ছিলেন। তাঁর ওই মন্তব্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে এ ব্যাপারে প্রশ্নের জবাবে কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি এ দিন বলেন, “রেল প্রতিমন্ত্রীর রবিবারের মন্তব্যের মধ্যে কোনও নেতিবাচক মনোভাব ছিল না। তিনি শুধু এটুকুই বলেছিলেন যে, তিনি অনেক দূরে রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেলে তিনি যাবেন।” তবে এই জবাব দেওয়ার সময়ও সিঙ্ঘভি জানতেন না, মুকুলবাবু অসমেও যাননি। কিন্তু পরে তা জানাজানি হলে কংগ্রেস নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে দলীয় সূত্রের খবর। তাঁদের মতে, প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছেন, তখন তাঁর ঘটনাস্থলে যাওয়াই উচিত ছিল। ঘটনাস্থলে যাওয়া, না-যাওয়া নিয়ে জলঘোলা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতেও। মুকুলবাবুর নাম না-করে তাঁর সমালোচনা করেছেন রাজ্যের সহকারী বিরোধী দলনেতা সুভাষ নস্কর। তিনি এ দিন বলেন, “দুর্ঘটনাস্থলে প্রতিমন্ত্রীর যাওয়া উচিত ছিল। উদ্ধারের কাজে আরও তৎপরতা প্রয়োজন ছিল।” ঘন ঘন রেল দুর্ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সুভাষবাবু বলেন, “যাত্রী সুরক্ষায় রেল মন্ত্রকের আরও সক্রিয় হওয়া দরকার।” |