আধো বুলিতে মাকে খুঁজছে ছোট্ট মেয়ে
চাদরে ঢাকা পরপর লাশ। তার মধ্যে সারা রাত ধরে পাগলের মতো ভাইকে খুঁজেছে তেরো বছরের মেয়েটা।
চাদর সরিয়ে দেখেছে লাশের মুখ। মিলছে না, মিলছে না। আশা চুইয়ে পড়েছে মনের কোণে। তা হলে বোধহয় ভাইটা...।
এ ভাবেই রাত কাবার।
কিন্তু দিনের আলোর সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল তার আশার আলো। ভোরবেলা সে খুঁজে পেল তার দশ বছরের ভাইকে। মৃতদেহের সারির মধ্যেই।
আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি সাহানা। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সে।
কী ঘটেছিল রবিবার দুপুরে? কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে সাহানা, “নীচের বার্থে শুয়ে ছিল শেহজাদ। হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনি। ছিটকে গেল কামরার অন্য দিকে।” সেই শেষ। আর ভাইকে দেখতে পায়নি সাহানা।
দিল্লি থেকে মা-বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে দিন কয়েক আগে কলকাতায় মামার বাড়িতে এসেছিল সে। শনিবারের দুপুরটা লণ্ডভণ্ড করে দিল সাহানার জীবন। সাহানা বলছিল, “চোখের সামনেই শেষ হয়ে গেল মা। বাবার পা দুমড়ে গেল। ভাইকে খুঁজছি তার পর থেকেই।”
সাহানার বাবা এখন হাসপাতালে ভর্তি। মা-ভাই হারানো কিশোরীর কান্না থামাতে পারছিলেন না কেউ। মেয়ের এক কথা, “কী করব এখন? কোথায় যাব? আমাদের সঙ্গে এমন কেন হল?”
ধ্বংসস্তূপে প্রাণের খোঁজের মধ্যে হঠাৎ পাওয়া গেল একরত্তি এক মেয়েকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। পাশেই পড়ে এক মহিলা ও কিশোরের দেহ। আধো গলায় শিশুটি শুধু বলছে, “মা-বাবা কোথায়? দাদা?”
অনেক প্রশ্ন করে জানা গেল, তার নাম লোরি। বাড়ি কলকাতায়। দিল্লি যাচ্ছিল বাবা-মা-দাদার সঙ্গে। পাশে পড়ে থাকা ওই মহিলা আর কিশোরই কি ওর মা আর দাদা? কিছুই বলতে পারছে না সে। শোকের অভিঘাত কী, বোঝার মতো বয়সও হয়নি তার। এর মধ্যেই কয়েক জন খুঁজলেন তার বাবাকে। পাওয়া গেল না। লোরির ঠিকানা এখন ফতেপুরের হাসপাতাল।
স্বজনহারা। মা ও ভাইকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে সাহানা। সোমবার মলওয়াঁয়। পিটিআই
বছর চারেকের বিক্রমের ভাগ্য অবশ্য এতটা খারাপ নয়। সে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছে তার বাবা-মাকে। লোয়ার কেজি-র ছাত্র বিক্রম বার্থ থেকে ছিটকে পড়েছিল দুর্ঘটনার ধাক্কায়। অন্ধকারে কাউকে দেখতে না পেয়ে প্রাণপণে চিৎকার করতে শুরু করে সে। চিৎকার শুনেই জানলার কাচ ভেঙে তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন গ্রামবাসীরা। তার আগেই অন্ধকারে হাতড়ে মা মুকুলা চৌধুরীকে খুঁজে বার করেছিল বিক্রম। মুকুলাদেবীর কথায়, “আমি চাপা পড়ে ছিলাম। উদ্ধারকারীরা এসে বিক্রমকে টেনে বার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ও আমায় ছেড়ে যেতে চাইছে না। আমায় টেনে হিঁচড়ে তুলতেই ‘বাবা কোথায় বলে’ কাঁদতে শুরু করে।” কামরার সম্পূর্ণ উল্টো দিক থেকে বিক্রমের বাবা হিরন্ময়কে উদ্ধার করা হয় বেশ কিছু ক্ষণ পর। যথেষ্টই জখম। আহতরা কোনওক্রমে বাড়ি ফিরতে চাইছেন। সিআরপিএফ-কর্মী হিরন্ময়বাবু কিন্তু ফতেপুর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এখন চাইছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চণ্ডীগড়ে, নিজের কাজের জায়গায় ফিরে যেতে।
ফতেপুর হাসপাতালে দেহ আর আহত মিলেমিশে হুড়োহুড়ি চরমে। এই লাশ আসছে, তো এই আনা হচ্ছে জখম যাত্রীকে। তার মধ্যেই খোঁজ পাওয়া গেল গুলাম বারির। সমানে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন ঈশ্বরকে। রাখে আল্লা মারে কে! দুর্ঘটনাগ্রস্ত এস-২ কামরার যাত্রী ছিলেন তিনি। বললেন, “আমার ওয়েটিং টিকিট ছিল। এক যাত্রীর সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে বসে যাচ্ছিলাম। সেই যুবক মারা গিয়েছে।” শুধু কী তাই, বারি বলেই চললেন, “জ্ঞান আসার পরে দেখি আমার উপরে পাঁচ জন পড়ে রয়েছে। তাঁদের মধ্যেও এক জন সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান।”
গত রাতে ৩২টা মৃতদেহ ফতেপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। এখন সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৪৪-এ। আহত প্রায় পঞ্চাশ জনের চিকিৎসা চলছে এখানে। বেশ কয়েক জনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কানপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এর মধ্যে ফতেপুর হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী যাতে কম না পড়ে, সে জন্য ইলাহাবাদ ও কানপুর থেকে অতিরিক্ত লোক আনা হয়েছে। আহতদের রক্ত যাতে কম না পড়ে সে জন্য অতিরিক্ত রক্ত মজুত করে রেখেছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালেই খোঁজ মিলল রাণু ঘোষের। মেরুদণ্ডে চোট পেয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। কলকাতা থেকে দিল্লি যাচ্ছিলেন আত্মীয়ের বিয়েতে। পরিবারের বাকিরাও কমবেশি আহত। দুর্গাপুর থেকে কালকা যাচ্ছিলেন সৈকত ঘরামি, ভাই চিরঞ্জীত ও কাকা শুভঙ্কর। চোট লাগলেও এখন বিপদমুক্ত দুই ভাই। কিন্তু কাকা শুভঙ্কর ইমার্জেন্সিতে ভর্তি। মলওয়াঁ স্টেশনের কাছে তখন দুর্ঘটনার দগদগে চিহ্ন ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র। আত্মীয়-পরিজনের খোঁজ, দেহ ঘিরে হাহাকার ছড়িয়ে আছে বাতাসে। তার মধ্যেই আসতে শুরু করলেন রাজনৈতিক নেতারা। সামনে বিধানসভা ভোট। তার আগে রোগীর পাশে দাঁড়াতে হবে তো! তাই পাঁচ-সাতটা গাড়ির কনভয় নিয়ে আসছেন এক এক জন। সঙ্গে আনছেন দুধ, পুরি-হালুয়া। কেউ বা জামা-জুতো। কেউ বিস্কুট, আপেলে খাবারে ভরিয়ে দিচ্ছেন রোগীদের বিছানা। এই সব নিয়ে তাঁরা হানা দিচ্ছেন হাসপাতালেও। মুষলধারে বৃষ্টিও আটকাতে পারেনি তাঁদের। এতে আরও লণ্ডভণ্ড হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থা।
কিন্তু কে খাবে এত খাবার? বিছানায় শুয়ে যাঁরা, তাঁদের এ সব খাওয়ার ক্ষমতাই নেই!
Previous Story Desh Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.