বিভীষিকার যাত্রা
পয়েন্টের ত্রুটি নিয়েও ভাবনা রেল মহলে
তটুকু বিশ্রাম পাওয়ার কথা ছিল দুর্ঘটনাগ্রস্ত কালকা মেলের ওয়াপ-৭ ইঞ্জিনের, তা তাকে দেওয়া হয়নি। বিশ্রামের ফাঁকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাও সম্ভব হয়নি।
দিল্লি থেকে কালকা, কালকা থেকে হাওড়া, আবার হাওড়া থেকে কালকা একটানা ছুটেই চলেছে সেই ইঞ্জিন। কালকা মেলের দুর্ঘটনার দেড় দিনের মধ্যে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে দুর্ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে রেল কর্তারা তুলে ধরলেন এই তথ্য।
রেলকর্তাদের মতে, প্রতিটি দূরপাল্লার যাত্রার পরে ইঞ্জিনকে কিছুটা বিশ্রাম দেওয়ার কথা। সেই সময় তার চাকা থেকে শুরু করে অন্য সব যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করার কথা। বিশ্রামের সময় না-মেলায় কালকা মেলের ওই ইঞ্জিনের সেই সব পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি বলে সোমবার রেল মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে। রেল অফিসারদের একাংশের বক্তব্য, যত ট্রেন চলছে, তার তুলনায় ইঞ্জিনের সংখ্যা কম। ফলে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম দেওয়া যাচ্ছে না দূরপাল্লার ট্রেনের ইঞ্জিনগুলিকে।
রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান বিনয় মিত্তল সোমবার দাবি করেছেন, রেল লাইনে কোনও সমস্যা ছিল না। ফিশপ্লেট পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, তা-ও ঠিকঠাক ছিল। সিগন্যাল ব্যবস্থায় কোনও সমস্যা ছিল না বলেই প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে। তাঁর আরও দাবি, রেলকর্মীরা জানিয়েছেন, কালকা মেলটি যখন ৯২৭/২৩ নম্বর পোস্টের কাছে ছিল, তখন তার ইঞ্জিনকে কাঁপতে এবং সেখান থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখা গিয়েছে।
শেষ-যাত্রা। কালকা মেলের দুমড়ে যাওয়া কামরায় এ ভাবেই আটকে রয়েছে মৃতদেহ। সোমবার মলওয়াঁয়। পিটিআই
মনে করা হচ্ছে, বছর দুয়েক আগে ওড়িশার জাজপুরে যে ভাবে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা ঘটেছিল, মালওয়াঁয় কালকা মেলের দুর্ঘটনায় সম্ভবত সেই ভাবেই ঘটেছে। সে দিন করমণ্ডল এক্সপ্রেসও ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার বেগে ছুটে যাচ্ছিল। আচমকাই প্রচণ্ড শব্দ করে ট্রেনের ইঞ্জিনটি লাইন থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ে। পিছন পিছন কামরাগুলিও এ দিক ও দিক উল্টে পাল্টে, দুমড়ে মুচড়ে একটি অন্যটির মাথায় চড়ে বসে। কালকার মতো সে বারেও রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, ইমার্জেন্সি ব্রেক ব্যবহার করাতেই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
রেল অফিসারদের একাংশের বক্তব্য, যে প্রযুক্তিতে ইমার্জেন্সি ব্রেক সিস্টেমটি তৈরি হয়, তাতে ব্রেক কষলে গাড়ি উল্টে যাওয়ার কথা নয়। ফলে, ইমার্জেন্সি ব্রেক কষা ছাড়াও দুর্ঘটনার অন্য কারণ রয়েছে, এমন ধারণা ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে। আপাতত যে কারণগুলির খোঁজা হচ্ছে সেগুলি হল, কোন পরিস্থিতিতে চালককে ইমার্জেন্সি ব্রেক কষতে হল? ইঞ্জিনে কি কোনও গোলমাল হয়েছিল? যার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন বিনয় মিত্তল। নাকি, লাইনে কোনও গোলমাল ছিল? কেবিনের পয়েন্টে গোলমালের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না।
এই পয়েন্টের কাছেই বেলাইন হয় কালকা মেল। দেশকল্যাণ চৌধুরী
দুর্ঘটনাগ্রস্ত কালকা মেলকে যে ইঞ্জিন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, সেই ওয়াপ-৭ ইঞ্জিন বিদেশি প্রযুক্তিতে গাজিয়াবাদের রেল কারখানায় তৈরি করা হয়। রেল মন্ত্রকের একটি সূত্র জানাচ্ছে, একেবারে নতুন প্রযুক্তিতে তৈরি এই ইঞ্জিনগুলি বর্তমানে রাজধানী, দুরন্ত, কালকা-সহ দূরপাল্লার গুরুত্বপূর্ণ সব ট্রেনে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে ছুটতে পারে এই ইঞ্জিন।
কিন্তু রেল অফিসারদের একটা অংশের বক্তব্য, এই ওয়াপ-৭ ইঞ্জিনগুলিতে সম্প্রতি বড় মাপের একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যাওয়ার সময়ে আধুনিক এই রেল-ইঞ্জিনের চাকা কখনও কখনও লাইন থেকে নেমে যাচ্ছে। সেটা বুঝতে পেরে চালক আচমকা ব্রেক কষলেও এড়ানো যাচ্ছে না দুর্ঘটনা! কারণ, ইঞ্জিন থেমে গেলেও ইঞ্জিনের কাপলিং ভেঙে যাওয়ার ফলে পিছনের কামরার ব্রেক ধরছে না! পিছন থেকে একের পর এক কামরা এসে ধাক্কা মেরে তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে যে ক’টি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে তাদের অধিকাংশই চলছিল এই ইঞ্জিনে। সম্প্রতি দু’বার হাওড়া-রাজধানীর দু’-তিনটি কামরা এই ইঞ্জিন সমেত লাইনচ্যুত হয়।
অভিযোগ, ওয়াপ-৭ ইঞ্জিনের ব্রেকের একটি অংশও (ব্রেক হ্যান্ডার) মাঝে মাঝে খুলে পড়ে যায়। তারও উদাহরণ রয়েছে রেল অফিসারদের কাছে। কালকা মেলের ক্ষেত্রেও সেটি পড়ে চাকায় আটকে গিয়ে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাই রেলের মেম্বার (মেকানিক্যাল) সঞ্জীব হন্ডার নেতৃত্বে কালকার ইঞ্জিন নিয়ে সবিস্তার তদন্ত শুরু হয়েছে।
ইঞ্জিনের ত্রুটি ও পয়েন্টের গোলমালকেই প্রাথমিক ভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন রেলকর্তারা। মালওয়াঁ স্টেশনের সামনে যে পয়েন্ট (৬৪বি) রয়েছে, অর্থাৎ যেখান থেকে লাইনগুলি ভাগ হয়ে গিয়েছে, সেখানেই কালকার ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ সেখানেই রেল লাইন সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, লাইনচ্যুত হওয়ার পরে গাড়ি থামাতে ইমার্জেন্সি ব্রেক কষতে বাধ্য হন চালক। কিন্তু তাতে একে একে পিছনের কামরাগুলিতেও ব্রেক কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু এই ব্রেক প্রথম দু’টি কামরায় কাজ করতে না-করতেই ওয়াপ-৭ ইঞ্জিনের যে সমস্যা, সেই কাপলিং ভেঙে যায়। ফলে পরের কামরাগুলি হুড়মুড়িয়ে একে অন্যের ঘাড়ে এসে পড়ে।
প্রাক্তন রেলকর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুর বলেন, “কালকা যেখানে লাইনচ্যুত হয়েছে, সেই স্থানে পয়েন্ট থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই পয়েন্টের গোলমালের দিকে আঙুল উঠছে। তবে খতিয়ে দেখতে হবে, ওই লাইনে কালকার কত ক্ষণ আগে শেষ ট্রেন গিয়েছে। তার পরেই বোঝা যাবে পয়েন্টের গোলমাল ছিল কি না।”
ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার পরে চালক ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেছিলেন, না ইমার্জেন্সি ব্রেক কষার ফলেই ট্রেন লাইনচ্যুত হয়, সেই প্রশ্নের সুনিশ্চিত উত্তর অবশ্য এ দিনও মেলেনি। তবে মেল ও এক্সপ্রেস ট্রেনের অভিজ্ঞ চালকদের বক্তব্য, ঘণ্টায় ১৬০ কিমি গতিবেগেও যদি ইমার্জেন্সি ব্রেক কষা হয়, তা হলেও ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। রবিবার কালকা মেলের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০৮ কিমি। এই সময়ে ইমার্জেন্সি ব্রেক কষলে ট্রেন ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ট্রেন কোনও ভাবেই লাইনচ্যুত হবে না, বড়জোর ইঞ্জিনটি লাইনচ্যুত হয়ে যেতে পারে বলে তাঁদের দাবি।
চালকরা বলছেন, দিনের আলোয় ট্রেনের সামনে আচমকা কোনও বস্তু (পশু বা মানুষ) এসে পড়লে তা ৭০-৮০ মিটার দূর থেকেই আন্দাজ করা যায়। সে ক্ষেত্রে ইমার্জেন্সি ব্রেক কষার কোনও প্রয়োজন নেই। কালকা মেল ফতেপুর থেকে ছাড়ার পর কয়েকটি জায়গায় রেল লাইনে সংস্কারের কাজ চলছিল বলে কয়েক জন যাত্রী দাবি করেছেন। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ওই বিষয়টিও উড়িয়ে দিচ্ছেন চালকেরা। তাঁদের বক্তব্য, রেল লাইনে জরুরি ভিত্তিতে কাজ চললেও লাল পতাকা দিয়ে চালককে সর্তক করা হয়। দিনের স্পষ্ট আলোয় তা চালকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

(তথ্য সহায়তা: শুভাশিস ঘটক)

বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন:
First Page Desh Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.