আপনার কলমে...
১৭ আষাঢ় ১৪১৯ রবিবার ১ জুলাই ২০১২


উত্তরাখণ্ডের পথে পথে
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর পাণ্ডবদের মনে আত্মীয় হত্যার পাপ বোধ জেগে ওঠে। তখন শ্রীকৃষ্ণ এবং অন্যান্য ঋষিদের পরামর্শে পাণ্ডবেরা সেই ব্রহ্মহত্যার দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় ‘শিব আরাধনা’ শুরু করেন। তাঁরা প্রথমে কাশী-মহেশ্বরের কাছে গেলেন পাপস্খলনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু পাপের বোঝা এতই বেশি ছিল যে, স্খলন তো দূরস্থান, মহাদেব নিজেই লুকিয়ে পড়লেন উত্তরকাশীতে। পাণ্ডবরা তাঁর পিছু নিলে, তিনি ষাঁড়ের ছদ্মবেশ ধারণ করে গুপ্তকাশীতে আত্মগোপন করেন। কিন্তু পাণ্ডবরা তাঁকে চিনতে পারায়, মহাদেব দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন ভীম তাঁর ‘লেজ’ টেনে ধরেন। অতঃপর মহাদেব মাটির নীচে আত্মগোপন করেন। শিবের এই আত্মগোপনের বহিঃপ্রকাশ হল পঞ্চকেদার— কেদারনাথে পিঠের কুঁজ, রুদ্রপ্রয়াগে মুখ, তুঙ্গনাথে হাত, মদমহেশ্বরে পেট ও কল্পেশ্বরে কেশরাজি পড়েছিল। পাণ্ডবদের হাতে ধরা পড়ে মহাদেব ভাবলেন যে, তিনি একা এই পাপের বোঝা নিতে পারবেন না। তাই পার্বতীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দু’জনে একত্রিত হয়ে অর্ধনারীশ্বর রূপে পাণ্ডবদের সামনে উপস্থিত হলেন পাপ ভাগ করে নিতে।

উত্তরাখণ্ডের প্রতিটা পাহাড়ের খাঁজে মহাভারতের এমন সব ঘটনা ও চরিত্ররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আর সে সবকে চাক্ষুষ করতেই আমাদের বেরিয়ে পড়া, উত্তরখণ্ডের পথে।
হর কি পৌড়ি ও গঙ্গারতি
কলকাতা থেকে প্রথমে হরিদ্বার। সেখান থেকে হৃষিকেশ। তার পর উত্তরাখণ্ডের পথে পথে আমাদের হিমালয় পরিভ্রমণ। হরিদ্বারে ‘হর কি পৌড়ি’ এসে ঝপাং করে গঙ্গার জলে পা ডুবিয়ে মনে হল, বাঁচলাম! স্থানীয় মানুষজনের ভিড় বেশি, পর্যটক বড় একটা নেই এ সময়। ভোরের কুয়াশা মাখা আবছায়া দিগন্তরেখা আর সূর্য ওঠার প্রাক্ মুহূর্তের গঙ্গার ঘাট। সেই ক্লক টাওয়ার, সেই চেন বাঁধা ঘাট, গঙ্গার আরতি— কত বার দেখা, তবুও যেন পুরনো হয় না! সন্ধেবেলা দেবভূমির হেমন্তের বাতাসে একটু যেন ঠান্ডার ছোঁয়া। রাত হতেই ঘন আঁধার ঘিরে ধরে হিমালয়কে। দূর থেকে পাহাড়ের মাথায় ঝিকমিক আলো দেখে জানলাম মনসাদেবীর মন্দিরের কথা। ওটাই মনসা পাহাড়। কিছু দূর গেলে কঙ্খল— সাধুসন্তদের জায়গা।

হর কি পৌড়ির আক্ষরিক অর্থ হল ‘শিবের সিঁড়ি’। সমুদ্রমন্থনের পর গরুড় পাখি যখন কলসে করে অমৃত নিয়ে উড়ে চলেছে, তখন হরিদ্বারের গঙ্গায় সেই অমৃতের এক ফোঁটা পড়ে যায়। তাই এই জায়গাটিকে ব্রহ্মকুণ্ড বলা হয়। কথিত, বৈদিক যুগে নাকি ভগবান বিষ্ণু এবং মহেশ্বর এই ব্রহ্মকুণ্ড দর্শন করতে এসেছিলেন। আর এখানেই হয় কুম্ভমেলা। সারা বছর ধরে বহু পুণ্যার্থী আসেন স্নান করতে। প্রতিদিন সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের পূর্ব মুহূর্তে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে জনৈক পুরোহিত বিশালাকার প্রদীপ নিয়ে অপূর্ব আরতি করেন, গঙ্গাকে উদ্দেশ্য করে। মন্ত্রোচ্চারণ, ঘণ্টাধ্বনি আর শঙ্খের আওয়াজ অনুরণিত হয় গঙ্গার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। প্রচুর মানুষের সমাগম হয় তখন নদীর ধারে। প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসানো হয় জলে। সে বড় মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।

হরিদ্বার পেরোলেই একে একে হৃষিকেশ, রাম ঝুলা, লক্ষ্মণ ঝুলার দেখা পাওয়া যায়। হৃষিকেশকে বলা হয় ঋষিদের বাসস্থান। কেউ বলেন জটাজুটধারী হিমালয় যেন ঋষির কেশের মতো বেষ্টন করে রেখেছে এই স্থানকে। হৃষিকেশ গঙ্গার সমতলে অবস্থিত শান্ত এক শহর। এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে লক্ষ্মণ ঝুলা— গঙ্গার উপরে ঝুলন্ত সেতু। আদিতে, পাটের দড়ি দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই ঝুলা। রাবণ বধ করার জন্য রামচন্দ্র যখন গঙ্গার তীরে তপস্যা করছিলেন, তখন লক্ষ্মণ নাকি পায়ে হেঁটে সেই সেতু অতিক্রম করেছিলেন। ১৮৮৯ সালে লোহার ‘রজ্জু’ এবং কংক্রিটের স্তম্ভে তৈরি হয় লক্ষ্মণ ঝুলা। সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে গঙ্গার জলে বিশালাকার মহসীর মাছ দেখা যায়। পুণ্যার্থীরা মুড়ি, পয়সা, মাছের খাবার ফেলে সেতুর উপর থেকে। কপাল ভাল থাকলে মাছের দর্শনও পাওয়া যায়। এই মহসীর মাছই নাকি বিষ্ণুর মত্স্য অবতারের আসল রূপ। তবে তেহরির বাঁধের জন্য গঙ্গার গতি কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে এবং মাছেদের যাওয়া-আসাটাও অতটা নিশ্চিত নেই। কাছেই আছে মুনি কি রেটি, রাম ঝুলা এবং নীলকণ্ঠ মহাদেব মন্দির।

হৃষিকেশ ছেড়ে এ বার আমরা চলেছি জিম করবেট আর চিতা বাঘের জন্য বিখ্যাত রুদ্রপ্রয়াগের পথে। গঙ্গা তখন বেশ নীচ দিয়ে বইছে। আমরা পাহাড়ের উপর দিয়ে ব্যাসি, তিনপানি পেরোলাম। ‘রিভার রাফটিং’ হয় এই পাহাড়ি নদীগুলিতে। দেবপ্রয়াগ এল কিছু ক্ষণের মধ্যেই। পঞ্চপ্রয়াগের অন্যতম দেবপ্রয়াগ ভাগিরথী-অলকানন্দার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। দু’টি নদীর জলের রঙের সুন্দর তফাত বোঝা যায় এখানে। ভাগিরথীর রং ঘোলাটে— অতটা পথ উপর থেকে নেমে এসে কিছুটা বয়সের ভারে ন্যুব্জও বটে। অন্য দিকে অলকানন্দা মরকত মণির মতো চিরনবীনা, চিরসবুজ। দেবপ্রয়াগে দু’জনে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে গঙ্গার। ভাগিরথী এবং অলকানন্দার উপর নির্মিত ঝুলন্ত সেতু দিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে ঘুরে এলে নদী এবং পাহাড়ের একাত্ম হয়ে যাওয়া রূপ যেন মন ভরিয়ে দেয়। দেবপ্রয়াগ বর্তমানে তেহরি গাড়োয়াল জেলার অন্তর্গত। এখানে দশ হাজার বছরের প্রাচীন রঘুনাথজির মন্দির আছে। ২২ কিলোমিটার দূরে চন্দ্রবাদানী পাহাড়ের উপর আছে সতীমায়ের মন্দির। দক্ষযজ্ঞের পর সতীর ধড় পড়েছিল এখানে। এই পাহাড়ের উপর থেকে কেদারনাথ, বদ্রীনাথ এবং সিরকান্ডার অপূর্ব মোহময় তুষারশৃঙ্গ দর্শন করা যায়। দেবপ্রয়াগের খুব কাছেই ৩০৪৮ মিটার উঁচু হিমালয়ের আর এক পর্বত শৃঙ্গ নাগটিব্বা। ট্রেকিং করতে বহু মানুষ আসেন এখানে।

আবার রুদ্রপ্রয়াগের দিকে রওনা দিলাম, শ্রীনগর হয়ে। বদ্রীনাথ থেকে অলকানন্দা ও কেদারনাথ থেকে মন্দাকিনীর সঙ্গমস্থলে গড়ে উঠেছে রুদ্রপ্রয়াগ। আগে চামোলী ও তেহরিতে বিভক্ত রুদ্রপ্রয়াগ, এখন নতুন জেলায় পরিণত হয়েছে। পুরাণে কথিত আছে মহাদেবকে তুষ্ট করার জন্য নারদ মুনি রুদ্রপ্রয়াগে তপস্যা করেছিলেন। মহাদেব তাঁর রুদ্ররূপ ধারণ করে নারদের সামনে এসে তাঁকে আশীর্বাদ করে একটি বীণা উপহার দেন। নারদ এই স্থানে শিবের মহিমায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ব্যুত্পত্তি লাভ করেন। রুদ্রপ্রয়াগের প্রাচীন শিব মন্দির রুদ্রনাথ বা রুদ্রেশ্বর পাহাড়ের উপর ২২৮৬ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এটি পঞ্চকেদারের একটি। আরও উপরে আছে নারদশীলা, যেখানে নারদ তপস্যা করেছিলেন। দক্ষযজ্ঞের পর সতী এই স্থানে নাকি পুনর্জন্ম লাভ করেন।
কথিত আছে রুদ্রপ্রয়াগের অন্তর্গত মানা গ্রামে ব্যস-গুহায় বসে গণেশ বেদ লিখেছিলেন। এই মানা গ্রামটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, তুষারশৃঙ্গ দ্বারা বেষ্টিত এবং স্থানমাহাত্ম্যের জন্য আজও অমলিন। সঙ্গমের কাছেই রয়েছে জগদম্বা মন্দির। গাড়ি থেকে নেমে সরু পাহাড়ি পথ ধরে পাহাড়ের নীচে নামলাম। নদীর নীলচে সবুজ জলের প্রকৃত রং দেখব বলে। ঝুলন্ত সেতুর উপর দিয়ে কিছুটা এগোতেই চোখে পড়ল সেই সঙ্গম— একটি দেবলোকের নদী, অন্যটি ব্রহ্মলোকের। গয়ার রাজার যজ্ঞে অসন্তুষ্ট পরশুরাম মুনির অভিশাপে দু’লক্ষ ব্রাহ্মণ ব্রহ্মযোনিপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিলাভ করেছিল এই দুই নদীর সঙ্গমে।

রুদ্রপ্রয়াগ থেকে রাস্তা দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে— একটি রাস্তা কর্ণপ্রয়াগ হয়ে অলকানন্দার পাড় ঘেঁষে সোজা বদ্রীনাথের দিকে আর অন্যটি মন্দাকিনীর ধার দিয়ে কেদারনাথ মন্দিরের দিকে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অলকানন্দার পাড়ে কোটেশ্বরের গুহা মন্দির। এখানে প্রকৃতির ইচ্ছায় অবিরাম জলের ফোঁটায় সৃষ্টি হয় শিবলিঙ্গ!

এ বার আমরা গুপ্তকাশীর পথে, তিলওয়াড়া হয়ে। গাড়ি চলতে লাগল মন্দাকিনীর পাশ দিয়ে। গাড়োয়াল হিমালয়ের কোলে তখন সূর্য ঢলি ঢলি করছে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে অগস্ত্য মুনির মন্দির। গুপ্তকাশীতে একটা বহু পুরনো শিবমন্দির দেখলাম। মহাভারতের যুদ্ধের পর পাণ্ডবদের সকল পাপমুক্তি হয়েছিল এই মন্দিরে। এই মন্দিরে রয়েছে শিব-পার্বতীর অর্ধনারীশ্বর মূর্তি। আর রয়েছে একটি কুণ্ড যেখানে গঙ্গোত্রীর থেকে গঙ্গা আর যমুনোত্রী থেকে যমুনা এসে পড়ছে, দু’টি আলাদা মুখ দিয়ে। দু’টি প্রবাহের জলের স্বাদও সম্পূর্ণ আলাদা।

পাহাড়ের কোলে পুরনো শহর গুপ্তকাশী। গুপ্তকাশীর ভোর আমাদের জন্য বড় সুন্দর ছিল। ঘর থেকে গাড়োয়াল হিমালয় দেখলাম দু’চোখ ভরে। এ বারের গন্তব্যস্থল উখিমঠ। উখিমঠ রুদ্রপ্রয়াগ থেকে মাত্র ৪১ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ের উপর ১৩১১ মিটার উচ্চতায় ছোট্ট শহর। উখিমঠের সংস্কৃত নাম উষামঠ। পুরাকালে বানাসুরের রাজধানী ছিল এটি। শ্রীকৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধ, বানাসুরের মেয়ে উষাকে অপহরণ করেছিলেন। উখিমঠের মূল ও সর্ববৃহত্ মন্দির হল ওঙ্কারেশ্বর মন্দির। আরও অনেক ছোট মন্দির আছে উষা, অনিরুদ্ধ, শিব, পার্বতী এবং মান্ধাতা-র। দীপাবলীর পর যখন কেদারনাথ মন্দির বন্ধ হয়ে যায় তখন বিগ্রহ নিয়ে স্বয়ং পুরোহিত উখিমঠে এসে আশ্রয় নেন ছ'মাসের জন্য।

আমরা দেখলাম সেই মন্দির আর পুরোহিতের থাকার আশ্রম। পাহাড়ের উপর থেকে একফালি নীলচে রঙের মন্দাকিনীও চোখে পড়ে, যার এক পাশে গুপ্তকাশী আর অন্য পাশে উখিমঠ।

এক কথায়: অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর প্রতিটা পাহাড়ের
খাঁজেই মহাভারতের ঘটনা ও চরিত্ররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
 
কলকাতার বেলতলার বাসিন্দা হলেও বর্তমানে স্বামীর কর্মসূত্রে খড়্গপুরে বাস। ঘর গোছানো আর রান্নাবাড়ি করাতেই যত উত্সাহ। তবে নেশা যদি বলতেই হয়, তবে সেটা ঘুরে বেড়ানো আর ব্লগ লেখা।
ছবি: লেখক


রোজের আনন্দবাজার এ বারের সংখ্যা সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর স্বাদবদল চিঠি পুরনো সংস্করণ