আপনার কলমে...
১৭ আষাঢ় ১৪১৯ রবিবার ১ জুলাই ২০১২


কমিউনিটি ট্যুরিজমের অন্য নাম চুইখিম
বাগরাকোটে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক ছেড়ে ডানহাতি পথ ধরে আমাদের গাড়ি ঢুকে পড়ে বাগরাকোট চা বাগানে। পিচ ঢালা সোজা পথটা চলে গেছে লিস নদীর পাড়ে। আমরা চা বাগানের কুলি বস্তি, চা-বাবুদের কাঠের কোয়ার্টার, দোকানপাট, জলের কলে আসা মেয়েদের জটলা পিছনে ফেলে চুনাভাটি মোড় হয়ে ডান দিকের পথে ঢুকি। রাস্তা এ বার লোকালয় ছেড়ে ঝাঁপ দিয়েছে চেল রেঞ্জের অরণ্যে। আমাদের গন্তব্য এক অখ্যাত পাহাড়ি গ্রাম চুইখিম। চুই মানে নতুন, খিম মানে বসতি।

লেপচাদের নতুন বসতি— চুইখিম শিলিগুড়ি থেকে ৫৪ কিলোমিটার আর বাগরাকোট থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। সেখানে ২৫০ পরিবার নিয়ে এক নতুন পরীক্ষানিরীক্ষার কাজ চালাছে ‘শেয়ার’ (সাপোর্ট হিমালয়ান এগ্রো রুরাল এন্টারপ্রাইজেস)। সংস্থার প্রাণপুরুষ প্রশান্ত মল্লিকের হাত ধরে এখানে গড়ে উঠেছে সামাজিক ভ্রমণ— কমিউনিটি ট্যুরিজম। শুধু তাই নয় ‘শেয়ার’ আর স্থানীয় মানুষের প্রচেষ্টায় বন্ধ হয়েছে বহু কালের জাঁকিয়ে বসা পাহাড়ি ব্যাধি— মদ্যপান। পাহাড়ের গ্রামে মদ্যপান বন্ধ কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়! এ ব্যাপারে গ্রামের মেয়েরাই প্রধান উদ্যোগী। শেয়ার-এর উদ্যোগে গ্রামে শুরু হয়েছে পাকা শৌচাগার নির্মাণ, ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং গ্রামবাসীদের ঘরে পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও। এদের পরিকল্পনা অনেক, স্বপ্ন আরও বেশি।
ঘন জঙ্গলের বুক চিরে পাথুরে পথ গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় লিস নদী
চুনাভাটির মোড় থেকে চুইখিম অবধি, প্রায় বারো কিলোমিটার পাথুরে পথ গিয়েছে ঘন জঙ্গলের বুক চিরে। কোনও এক সময়ে পথে পিচের প্রলেপ পড়েছিল হয়তো। এখন পাথর বেরিয়ে সে রাস্তা বেশ দুর্গম। আমাদের জিপ, সারথি রাজেশের হাতে গর্জন তুলে ঘুরে ঘুরে উঠতে থাকে উপর দিকে। বাগরাকোট প্রায় সমতল। কিন্তু বাকি পথের পুরোটাই চড়াই। চুইখিমের উচ্চতা হাজার তিন হাজার ফুটের উপরে। চারপাশে ঘন জঙ্গল। ঝিঁঝি পোকার অবিরাম ‘ডাক’। এই ‘ডাক’ই নাকি অক্টোবর-নভেম্বরে হয়ে যায় মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনির মতো। তখন মনে হয় জঙ্গল জুড়ে পুজোর ঘণ্টা বাজছে। তবে এপ্রিলেও পথের ধারে নৈবেদ্য সাজানো থরে থরে— জঙ্গলে সারি সারি টগর গাছে ফুল ফুটেছে যে! কে যেন বড় যত্নে শ্বেত-শুভ্র টগরের গুচ্ছ সাজিয়ে রেখেছে প্রকৃতিদেবীর পুজোয়। পথের দু’ধারে আকাশ ছোঁয়া মহীরুহের সারি। ফাঁকে ফোকরে আলোছায়ার লুকোচুরি, জঙ্গলে অল্প অল্প নাক-জ্বালানো বুনো গন্ধ, পাতার আড়ালে নাম জানা আর না-জানা পাখির ডাক।

খানিক উঠে একটা বাঁকের মুখে জিপ থামল। নীচে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে লিস নদী। পেছনের পথ একটা বাঁক ঘুরেই হারিয়ে গিয়েছে গভীর জঙ্গলে। সবই যে ছবির বিষয়— উদাত্ত প্রকৃতির জলরঙে আঁকা নিটোল ছবি।

চুইখিমে উঠেছি পবিত্রা ভুজলের বাড়ি। অবিবাহিতা যুবতী পবিত্রা থাকে তার সেজ দাদার পরিবারের সঙ্গে। গ্রামে কমিউনিটি নির্ভর পর্যটনের এক উদ্যোক্তা তিনি। চুইখিমে আরও কয়েকটি বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে এই উদ্যোগ। গ্রামের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে একটা ছোট্ট টিলার উপরে পবিত্রা ভুজলের দু’ কামরার বাড়িটি শুধুই অতিথিদের জন্য। পিছনে কালচে-সবুজ পাইন গাছের ঘন জটলা। বাড়ির উঠোন থেকে দেখা যায় পাহাড়ের সবুজ ঢাল গড়িয়ে নেমে গিয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমের লিস নদীতে। পুরো গ্রামটাই ছড়িয়ে রয়েছে ঘাসে ছাওয়া সবুজ পাহাড়ের ধাপে ধাপে— দক্ষিণ থেকে পশ্চিমে। পাহাড়ের গায়ে ‘টেরাস কালটিভেশন’ বা ধাপ চাষের চিহ্ন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু’ একটা গাছ। বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়ের ঢেউ।
পাহাড়ের গায়ে ধাপ চাষের ছবি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সন্ধে নামে চুইখিমে
পড়ন্ত বিকেলে ঘাসে ছাওয়া উঠোনে চেয়ারে বসে রয়েছি, দেখি সূর্য খুব ধীরে ধীরে পাহাড়ের পেছনে অস্ত যাচ্ছে এক তাল কালো মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে। পশ্চিমাকাশ একটু একটু করে লাল হয়ে ওঠে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সন্ধে নামে চুইখিমে। আকাশের আলো নিভে গেলে পাহাড়ের ঢালে বাড়ি বাড়ি বিজলিবাতি জ্বলে ওঠে। নৈঃশব্দ্যের চাদরে শরীর ঢাকে চুইখিম।

আমি বসে থাকি এক নিরলস নিষ্ক্রিয়তার হাতছানিতে, নেশাগ্রস্তের মতো, বুঁদ হয়ে।

প্রয়োজনীয় তথ্য
• অবশ্যই আগাম বুকিং করে যাবেন। বুকিং-এর জন্য, Support Himalaya Agro Rural Enterprises (SHARE)-এর প্রশান্ত মল্লিক: 9433003080 , 9933312012, ইমেল: share.prasanta@gmail.com
থাকা খাওয়া: পবিত্রা ভুজলের বাড়ি। দু’ কামরা। লাগোয়া ঝকঝকে পশ্চিমী/ভারতীয় শৌচাগার। খরচ জনপ্রতি/ দিনপ্রতি ৯০০ টাকা।
যাতায়াত: ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি। সেখান থেকে গাড়িতে ৩১ নং জাতীয় সড়কে করোনেশান ব্রিজে তিস্তা পেরিয়ে মংপং, বাগরাকোট হয়ে চুইখিম (৫৪ কিলোমিটার)। বা নিউ মাল জংশন স্টেশনে নেমে গাড়িতে উল্টো পথে বাগরাকোট হয়ে চুইখিম।
নিজস্ব গাড়ি না থাকলে বাগরাকোট থেকে ১৪ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। ওদলাবাড়ি-চুইখিম জিপ আছে সারা দিনে একটা-দুটো। শিলিগুড়ি থেকে যাতাযাত গাড়িতে এক পিঠের ভাড়া ২৫০০-৩০০০ টাকা।

এক কথায়: সবই যে ছবির বিষয়— উদাত্ত প্রকৃতির জলরঙে আঁকা নিটোল ছবি।

পেশায় আমলা কিন্তু নেশায় ভ্রমণ কাহিনি লেখক। এ বিষয়ে তাঁর লেখা প্রচুর নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রে। ভ্রমণ বিষয়ক পাঁচটি বইও প্রকাশ পেয়েছে তাঁর।
ছবি: লেখক


রোজের আনন্দবাজার এ বারের সংখ্যা সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর স্বাদবদল চিঠি পুরনো সংস্করণ