আপনার কলমে...
১৬ শ্রাবণ ১৪১৯ বুধবার ১ অগস্ট ২০১২


চিনের প্রাচীরে কয়েক মুহূর্ত
তিহাস বইয়ের সেই ছবিটার সঙ্গে যে এমন আচমকাই দেখা হয়ে যাবে, তা আগে বুঝতে পারিনি। আসলে ‘দেশ’ থেকে ‘বিদেশে’ ফেরার পথে বিমান বিভ্রাটের জেরে যে ভাবে চিনের ‘গ্রেট ওয়াল’ দেখা হয়ে গেল, তাকে ‘বেড়ালের ভাগ্যে সিঁকে ছেঁড়া’ ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়! একটু বিশদে বলা যাক।
মাস খানেকের জন্য দেশে আসছি। শি-ট্যাক বিমান আড্ডা থেকে লস এঞ্জেলস হয়ে এয়ার চায়না ধরে বেজিং, সেখান থেকে সোজা দিল্লি। মাঝে বেজিং বিমানবন্দরে কিছু ক্ষণের বিরতি। সেই সময়টুকু হোটেলে থাকার কথা। ব্যবস্থা করে দেবে বিমান-কর্তৃপক্ষই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেদের খরচেই থাকতে হল সেখানে। বেজিং-এ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানবন্দর, অত্যন্ত আধুনিক ও ভীষণ পরিষ্কার। এখানকার প্রতিটা কাউন্টারেই অল্প বয়সী ছেলেরা কাজ করছে, কোনও মেয়ে চোখে পড়ল না। কেউই ঠিকমতো ইংরেজি জানে না বা বোঝেও না। হোটেলে দেখলাম সব ছোট ছোট মেয়েরা কাজ করছে, কোনও ছেলে কর্মী নেই। বেলা এগারোটা নাগাদ হোটেল ছেড়ে চিনা খাবার খাব বলে গেলাম ‘কাফে সম্বল’-এ। সেখানে নানা ধরনের চিনা খাবার। শেষে কাফের একটি মেয়ে ঠিক করে দিল— মাছের তরকারি, ভাত আর মাশরুম। কাফের মালিক এক জন মহিলা, নাম মিসেস লিও আর ম্যানেজার মণিকা। মাছের তরকারিতে আমাদের দেশের মতো আদার স্বাদ। তখনও হাতে বেশ খানিকটা সময়। লাউঞ্জে ঘুরেই সময় কাটাচ্ছি। বাইরে ঘন কুয়াশা। আর ভেতরে বারবার ঘোষণা হচ্ছে কোন উড়ান বাতিল বা কোনটি দেরিতে ছাড়বে। আমরা ঘুরে ঘুরে নানা জিনিস দেখছি। কিছু চিনা পুতুল কিনতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু দামে পোষাল না। লক্ষ করলাম সমস্ত দোকানে অল্পবয়সী মেয়েরা কাজ করছে। কোথাও কোনও বয়স্ক মহিলা বা
বেজিং বিমানবন্দরের ভিতরে
পুরুষ কর্মী দেখলাম না! অবশেষে বিকেলে আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিমান এল। বেজিং থেকে দিল্লি প্রায় সাত ঘণ্টার পথ। তবে বেজিং ছাড়ার সময় জানতেও পারলাম না এ পথে ফেরার সময় আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে!

প্রায় মাস খানেক পর ভারত ছেড়ে পরবাসে ফেরার পালা। পথ ও বিমান একই। দিল্লি বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারলাম বেজিং থেকে বিমানই আসেনি, ১৬ ঘণ্টা দেরিতে আসবে সে, মানে পরের দিন দুপুরে ছাড়বে। রাতে হোটেলে থাকতে হবে।

পর দিন দুর্গা নাম জপতে জপতে দুপুরে বিমান ধরলাম। বেজিং-এ নামার ঘণ্টা খানেক পরেই লস এঞ্জেলস যাওয়ার উড়ান। কিন্তু ট্রানজিট কাউন্টারে গিয়ে তার সময় জানতে চাইলে কোনও সদুত্তর পাওয়া গেল না। এক জন মোঙ্গোলীয় মহিলা খবর নিয়ে এসে বললেন, কোনও বিমান নেই এখন, সবাইকে হোটেলে যেতে হবে ব্যাগেজ নিয়ে। রাত তখন প্রায় দু’টো। অভিজ্ঞরা বললেন, এখানে বিমান-বিভ্রাট নিত্য ব্যাপার। কী আর করা! বাইরে বেরিয়ে দেখি শেষ বাস ছাড়বে ছাড়বে করছে। প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বাইরে তাপমাত্রা প্রায় ৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট। আমার সম্বল একটা সোয়েটার আর বদ্রীনাথ যাওয়ার পথে কেনা একটা শাল। কোনও রকমে হোটেল পৌঁছলাম, আর জানতে পারলাম যে লস এঞ্জেলস যাওয়ার বিমান পর দিন রাত দশটায়। সন্ধে সাতটায় বাস এসে সকলকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে। মানে পরের পুরো দিনটাই হোটেলে কাটাতে হবে! তখনও কি ছাই জানি, আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে!

হোটেলের নাম ‘গোল্ডেন ফোনিক্স’। বোর্ডিং পাস কাউন্টারে জমা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম। সকাল সাড়ে ছটার আগে হোটেলের ‘কিচেন’ খোলে না। তাই জল খেয়েই শুয়ে পড়লাম। পর দিন সকাল হতেই খেতে ছুটলাম। আর সেখানেই কথায় কথায় উঠল ‘গ্রেট ওয়াল’-এর কথা। ঘুরে আসা যায় না! হাতে তো অনেকটা সময় রয়েছে! ব্যস, যেমন ভাবা তেমন কাজ।বেশ কয়েকজন রাজি হয়ে গেল। মাথা পিছু ৫০/৫৫ ডলার বা ৩৪৫ ইয়েন লাগবে— দুপুরের খাওয়া এবং গ্রেট ওয়ালে প্রবেশ করার টিকিটের দাম সমেত। তার পর কী আর খাওয়ায় মন থাকে! তার উপর খাবার দেখে আমরা যথেষ্ট অবাক! মাত্র ৮/৯টা সেদ্ধ ডিম, দু’রকমের ফেনা ভাত— একটা সাদা, নুন না দেওয়া (ওদের কথায় পোরিজ), অন্যটায় কী যেন মেশানো। দেখে মনে হল পর্কের কুচি, চিনা বাঁধাকপি পাতা সেদ্ধ, একটা ছোট্ট বাটিতে মাশরুম সয়া সস্ আর লাল লঙ্কা দেওয়া অসহ্য নোনতা টোফু ভাজা, কিছু বিকট গন্ধযুক্ত বান আর চপ স্টিক। কোনও টেবিলে নুন নেই, কাঁটা-চামচ নেই, জল নেই, চা বা কফি নেই। একটু ফেনা ভাত, মাশরুম, দু’ এক টুকরো টোফু আর পাতা সেদ্ধ খেয়ে পেটের জ্বালা মেটানো গেল। কর্তা খালি একটা ডিম সেদ্ধ খেলেন। মনে ‘ইতিহাস’ দর্শনের তীব্র আনন্দ। তাই খাবারের বিষয়টাকে খুব একটা পাত্তা দিলাম না।

হোটেল থেকে বেরিয়ে ‘গ্রেট ওয়াল’-এর পথে
একটা বড় ভ্যানে আমরা ন’ জন, গাড়ি চালক আর গাইড নাম জ্যাকি ওয়াং। হোটেল থেকে গ্রেট ওয়াল প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। যেতে লাগবে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক। ঠিক হল, যাওয়ার পথেই খেয়ে নেব। ব্রেকফাস্টের অভিজ্ঞতা সবার একই! ঠিক হল জ্যাকি একটা ভাল রেস্তোরাঁতে নিয়ে যাবে আমাদের।

হোটেল থেকে প্রায় সোজা রাস্তা। রাস্তার এক দিক জুড়ে ৩০/৪০ তলা ফ্ল্যাট বাড়ি। রাস্তাটা ফ্রি-ওয়ে, একটু উপরে, অনেকটা ফ্লাই ওভারের মতো। নীচ দিয়েও অনেক রাস্তা, যেখান দিয়ে ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর যাতায়াতের পথ, দোকান বাজার, বাস চলাচল করে। বেশি লোকজন চোখে পড়ল না। কোথাও কোথাও বাস স্টপ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু লোক বাসের জন্যে অপেক্ষা করছে। প্রাইভেট গাড়িও খুব একটা দেখলাম না। তবে এখানে ফ্রি-ওয়েতে আলাদা একটি লেন আছে অ্যাম্বুলেন্স বা অন্য আপত্কালীন অবস্থার জন্য।

গ্রেট ওয়াল প্লেস রেস্টুরেন্ট— একটা জেড ফ্যাক্টরির ভেতর দিয়ে পৌঁছলাম বহু প্রতিক্ষীত এই রেস্তোরাঁয়। ভাত, চিকেন, নানা ধরনের সব্জি, ব্রোকোলি, চিনা বাঁধাকপি, বামবুস্যুট, সেদ্ধ জুকিনি , চিংড়ি মাছ ভাজা, এক ধরনের মিষ্টি স্প্রিং রোল আর কোকাকোলা। যে যত খাও। প্রায় দু’দিন পরে একটু ভাল করে খেতে পেলাম। কর্তার জন্যে মন খারাপ হল, কি জানি কী খেতে পাবে ওই হোটেলে!

পেট শান্ত করে আবার রওনা দিলাম গ্রেট ওয়ালের দিকে, শহর ছাড়িয়ে। গাইড জ্যাকির ভারতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে। সে ট্যুরিজম নিয়ে পড়াশুনো করেছে। এ দেশে এক রাজ্য থেকে অন্য
রাস্তার ধারে এমন দৃশ্যই ক্যামেরায় ধরা পড়ে
রাজ্যে যেতে হলে সরকারি অনুমতিপত্রের প্রয়োজন হয়। চিন দেশে মাত্র চারটে টিভি চ্যানেল আছে, সরকার চালিত। ফ্রি-ওয়ের দু’ধারে মাইলের পর মাইল জুড়ে গাছের ঝোপ, সবুজ কাপড়ে ঢাকা বরফের হাত থেকে বাঁচাতে। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে বড় বড় পাঁচিল, যেন কিছু আড়াল করা হয়েছে। আমাদের সঙ্গের একটি ছেলে তাইওয়ানে ছিল কিছু দিন। রহস্য ভেদ করে সে বলল যে ফ্রি-ওয়ে থেকে যাতে কোনও বস্তির মতো জায়গা পর্যটকদের চোখে না পড়ে, সেই জন্যেই এই পাঁচিল। ক্রমশ আমরা পাহাড়ের এলাকায় চলে এলাম।

জ্যাকির মুখে শুনলাম ‘দিকসিয়া চেং’— বেজিঙের ভূগর্ভস্থ শহরের কথা। ৮৫ বর্গ কিলোমিটার লম্বা টানেল, বেজিং শহরের তলায় প্রায় ২৬ থেকে ৫৯ ফুট মাটির নীচে। এটি তৈরি করা হয় ১৯৭০ সালে, মাও জে দং-এর নেতৃত্বে। যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যই ছিল এই ব্যবস্থা। প্রায় ৩ লাখ লোকেরও বেশি, এমনকী স্কুলের ছেলে মেয়েরাও হাত লাগিয়েছিল এই নির্মাণ কাজে। ৬০ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিতে পারে এই টানেল। এখানে স্কুল, ক্লিনিক, রেস্তোরাঁ, থিয়েটার, কারখানা, স্কেটিং করার জায়গা, এমনকী মাশরুম চাষ করার ফার্ম, খাবার জলের ইঁদারাও রয়েছে। ৯০টা প্রবেশ পথ— বেশির ভাগই প্রধান রাস্তার দোকানের মধ্যে দিয়ে গুপ্ত পথ। কেবল তিনটে প্রবেশ পথ সবার জানা—
১. ৬২ ওয়েস্ট দামোং স্ট্রিট, কুয়েনমেন
২. বেজিং কুয়েনমেন কার্পেট ফ্যাক্টরি, ৪৪ জিংফু দাজি, চংওয়েন জেলা
৩. ১৮ দাজহালান জি, কুয়েনমেন
বর্তমানে বিদেশি ভ্রমণকারীদের অনুমতি দেওয়া হয় কিছু কিছু এলাকায় যাওয়ার। অনুমতি নিয়ে যদি দেখতে পারতাম!

জ্যাকির কথা শুনতে শুনতেই চলে এলাম গ্রেট ওয়ালের প্রবেশদ্বারে। ঝলমলে সোনা রোদ, নীল আকাশ, চারিদিকে পাহাড় আর দূরে গ্রেট ওয়ালের অংশ— সব মিলিয়ে বর্ণময় এক ছবি।
গ্রেট ওয়ালের প্রবেশদ্বারে
আমাদের গাড়ি থামল পার্কিং-এ। গাড়ি থেকে নেমেই প্রচণ্ড ঠান্ডার এক ঝটকায় জমে যাওয়ার অবস্থা হল। চারপাশে অনেক দোকান— সোয়েটার, কোট, টুপি, মাফলার, দস্তানার পসরা। পার্কিং থেকেই সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। ভীষণ পরিষ্কার চারিদিক, কোথাও এক টুকরো কাগজও পড়ে নেই। তবে সিঁড়ির কোণে কোণে বরফকুচি, রোদ্দুরে হীরের মতো জ্বলজ্বল করছে। দেখে বুঝলাম যে বরফের পলেস্তরা ছিল, পরিষ্কার করা হয়েছে। সিঁড়ি ভেঙে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হল ওয়ালের প্রবেশ দ্বারে। চেকিং-এর পর জ্যাকির সঙ্গে ভিতরে ঢুকে ওর কথা শুনতে শুনতে হাঁটা দিলাম ওয়ালে।

২২০-২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে প্রথম ওয়াল তৈরি করে চিনের সম্রাট কিন সি হুয়াং। তার কিছু ভগ্নাবশেষ দেখতে পেলাম। তবে এখন যে ওয়াল দেখা যায়, সেটা তৈরি হয় মিং সাম্রাজ্যে। প্রাচীর পুব থেকে পশ্চিম দিকে চলে গেছে। চিনের রাজা যাযাবরদের আক্রমণ থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্যই এই প্রাচীর তৈরি করেন। পাথর, ইঁট, কাঠ, মাটি আর অন্য সব প্রাকৃতিক জিনিস দিয়ে তৈরি হয় এই প্রাচীর। এ ছাড়া পাথরের নুড়ি, চক, আর চুনা পাথরের এক বিশেষ ধরনের মিশ্রণ ‘র‌্যাম্পড্ আর্থ’ ব্যবহার করা হয়।
এখন যে ওয়াল দেখা যায়, সেটা তৈরি হয় মিং সাম্রাজ্যে
চারটে ‘স্কোয়ার লুক আউট টাওয়ার’ দেখে আস্তে আস্তে রেলিং ধরে নেমে এলাম সকলে। জ্যাকির থাকার কথা কাছের একটা কফি হাউসে। সেখানে হাল্কা জলখাবারের সুন্দর ব্যবস্থা। আশেপাশের দোকানে জেডের গহনা, পুতুল, গরম জামা, সোয়েটার, পাওয়া যাচ্ছে আরও কত কী! একটি মেয়ে সাদা টি-সার্টে নানা ধরনের নকশা এঁকে বিক্রি করছে। খদ্দেররা নকশা পছন্দ করে দিলে, মেয়েটি সেটাই এঁকে দিচ্ছে। খুব সুন্দর হাতের কাজ। সবাই কফি হাউসে জড়ো হলাম। ঠিক করেছিলাম সময় হাতে থাকলে তিয়ানমেন স্কোয়্যার যাব। কিন্তু জ্যাকি রাজি হল না, কারণ রাত দশটার বিমান ধরতে সাতটায় হোটেলের বাস ধরে বিমানবন্দরে যেতে হবে।

অগত্যা! ফিরতেই হল। তবে আনন্দিত মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে বারবার, বিমান বিভ্রাটের কারণে এমন ‘ঐতিহাসিক স্থল’ দেখার ‘সৌভাগ্য’ জীবনে আর কখনও আসবে কী?

এক কথায়: ঝলমলে সোনা রোদ, নীল আকাশ, চারিদিকে পাহাড়
আর দূরে গ্রেট ওয়ালের অংশ— সব মিলিয়ে বর্ণময় এক ছবি।

১৯৮১ সাল থেকে মার্কিন দেশেই বসবাস। পেশায় ‘কমিউনিটি কলেজ ইনস্ট্রাকটার’ এবং হিসাব রক্ষক। নানাবিধ শিক্ষার মধ্যে ভূগোল একটি বিশেষ বিষয়। ভারত ও মার্কিন দেশ জুড়ে বহু জায়গাই ঘোরা। আসলে বেড়ানোটাই একমাত্র ভাল লাগার অস্তিত্ত্ব।
ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা



রোজের আনন্দবাজার এ বারের সংখ্যা সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর স্বাদবদল চিঠি পুরনো সংস্করণ