|
||||
নীল নদের উপত্যকায় ফারাওদের দেশে | ||||
হিমালয় নির্ঝর দাস | ||||
আরব সাগর পার হতেই বিমানের জানলায় দেখছি ধুধু মরুভূমি। সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামল দেশের সরস মাটি থেকে একেবারে আলাদা। হলুদ আর বাদামি রঙের বিস্তীর্ণ মরুভূমি মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে রয়েছে। মাঝে লোহিত সাগরের জলটুকু পার করেই আবার হলুদ বালিয়াড়ি, এ বার আফ্রিকায়। আকাশ থেকেও দেখছি নীচে শুধুই রুক্ষতা। এর মধ্যেই বিমান নামল নীল নদের গা ঘেঁষে কায়রোতে। ইজিপ্ট এয়ারের সরাসরি উড়ানে মুম্বই থেকে কায়রো পৌঁছতে ছ’ঘণ্টা লাগে। মিশরের সময় আমাদের থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পিছিয়ে থাকায় (গ্রীষ্মের তিন মাস ছাড়া) কার্যত মাত্র আড়াই ঘণ্টাতেই কায়রো চলে এলাম।
মিশরের সর্বপ্রধান দ্রষ্টব্য পিরামিড ও মমি। তার পরেই আসবে দক্ষিণ থেকে উত্তরে ছড়িয়ে থাকা নীল নদের উপত্যকায় ফারাওদের ঐতিহাসিক কীর্তি। স্কুভা ডাইভিং আর সমুদ্র উপভোগ করতে হলে আসতে হবে লোহিত সাগরের ধারে হার্ঘাদা, শার্ম-এল-শেখ অথবা সুয়েজে! মরুভূমির বেদুইন জীবনের আঁচ পেতে হলে বুকে সাহস নিয়ে পাড়ি দিতে হবে পশ্চিমের মরুভূমিতে। সিওয়া, বাহারিয়া, ফারফারা, দাখিলা ও খারগা এই পাঁচটি মরূদ্যান আছে সেখানে। ফারফারার কাছেই আছে চক পাথরে ঢাকা অপূর্ব শ্বেত মরু। বাদ দেওয়া যাবে না ভূমধ্যসাগরের তীরের আলেকজান্দ্রিয়াকেও। আমাদের প্রথম গন্তব্য গিজার পিরামিড। নীল নদ পার হয়ে এলাম গিজায়। নীল নদের দু’ধারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কায়রো ও গিজা, অনেকটা হাওড়া-কলকাতার মতো। মরুভূমির বালির মধ্যে জেগে আছে অনেক পিরামিড, তাদের মধ্যে তিনটিই প্রধান। প্রথম পিরামিডটা হল চতুর্থ সাম্রাজ্যের ফারাও খুফুর। কালের গ্রাসে উপর থেকে প্রায় ৮ মিটার মুছে যাওয়ার পরেও খুফুর পিরামিডটাই সবচেয়ে উঁচু— ১৩৯ মিটার। তার ওজনও বলার মতো— ৬০ লক্ষ টন। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে লিঙ্কন ক্যাথিড্রাল তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত চার হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে খুফুর পিরামিডই ছিল মানুষের গড়া উচ্চতম স্থাপত্য। পরের পিরামিড খাফ্রির। খুফুর ছেলে খাফ্রি একটু উঁচু জায়গা বেছেছিলেন তার পিরামিড বানানোর জন্য। তাই উচ্চতায় খুফুর চেয়ে সামান্য কম হলেও দেখতে খাফ্রির পিরামিডকেই উঁচু মনে হয়। পিরামিড বানানো সম্পূর্ণ হওয়ার পর মৃত ফারাওয়ের মমি আর তার ব্যবহার্য সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস সেখানে রেখে দেওয়া হত। পিরামিডের প্রবেশ পথটাকে ভাল করে পাথর চাপা দিয়ে লুকিয়ে ফেলা হত যাতে চোর-ডাকাত বা অন্য কেউ ফারাওয়ের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে। খুফুর সমাধিস্থলটা পিরামিডের অনেকটা ভেতরে। সরু ও ঢালু একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে বারবার বাঁক ঘুরে সেখানে পৌঁছতে হয়। খাফ্রির সমাধিস্থলে যাওয়ার সুড়ঙ্গটা তুলনামূলক ভাবে ছোট বলে সেটাই দেখব বলে মনস্থ করলাম। সম্ভবত ফারাওদের সময়ে, শুয়ে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এই সুড়ঙ্গ দিয়ে যাতায়াত করা হত। এখন যাত্রীদের সুবিধের জন্য পা রাখার মতো অস্থায়ী ধাপ বানানো হয়েছে। তবু ভ্যাপসা গরমে দমবন্ধ করা অবস্থায় মাথা নিচু করে হেঁটে সমাধিস্থল পর্যন্ত পৌঁছনো বেশ কষ্টকর। সেখানে আছে ফারাওয়ের সার্কোফেগাস (কফিন), যাতে মমি রাখা হত। এখন সমস্ত মমিগুলিকেই তুলে পৃথিবীর বিভিন্ন মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই পাথরের তৈরি ভারী সার্কোফেগাসটাকেই শুধু দেখলাম। আর আভাস পেলাম ফারাওদের জন্য কি পরিমাণ জিনিস রাখা হত এখানে! খাফ্রির পাশে মেনকাওরির পিরামিড। এই তিনের মধ্যে এটাই সবচেয়ে ছোট। গিজার পিরামিডের সামনে তাদের অভিভাবকের মতো দাঁড়িয়ে বিশালাকায়, রহস্যময় স্ফিংস। সন্ধ্যায় ‘সাউন্ড অ্যান্ড লাইট’-এর শোতে নিজের জীবনকথা শোনায় স্ফিংস। এই নিখুঁত নির্মাণগুলি প্রাচীন মিশরীয়দের অসাধারণ জ্যামিতিজ্ঞানের পরিচয় দেয়। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে, প্যাপাইরাসের গায়েই নিশ্চয়ই পিরামিড বানানোর নকশা আঁকা হয়েছিল। কায়রোতে এসে তাই প্যাপাইরাস মিউজিয়াম (গোল্ডেন ঈগল প্যাপাইরাস মিউজিয়াম, সাকারা) দেখতে ছাড়লাম না। প্যাপাইরাস গাছের ডাঁট বার করে, তাদের পাতলা করে কেটে, জলে ভিজিয়ে, রুটির মতো বেলে, তার পর রোদে শুকিয়ে প্যাপাইরাস তৈরি করা হত— এখান থেকেই ইংরেজিতে ‘পেপার’ শব্দ এসেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম এক বিরাট বাজারে— খান-এল-খিলিলি। শুধু ঘুরে ঘুরে বেড়ালেও এখানে বেশ সময় কেটে যায়। অবশ্য কিছু কেনাকাটা করতে হলে দরদাম করার দক্ষতা প্রয়োজন। পর দিন গেলাম কায়রো মিউজিয়ামে। একতলায় প্রবেশের মুখেই বিখ্যাত রোজেটা স্টোনের প্রতিকৃতি, যাতে গ্রিক ও মিশরীয় চিত্রলিপি (hieroglyph) এক সঙ্গে লেখা। এর থেকেই মিশরীয় চিত্রলিপির পাঠোদ্ধার শুরু হয়। এখানে শুধুই প্রতিকৃতি, আসল পাথরটি দেখতে হলে লন্ডনের বৃটিশ মিউজিয়ামে যেতে হবে। মিউজিয়ামের একতলায় ফারাওদের নানা মূর্তি। কালো পাথরের বিশাল ‘মমিফিকেশন’ টেবিলও দেখলাম এখানে। দোতলার প্রথমেই বালক ফারাও তুতান খামিনের গ্যালারি। মাত্র দশ বছরের রাজত্বকালে মিশরের প্রতি বিশেষ কোনও অবদান নেই তাঁর। কিন্তু অসম রাজৈশ্বর্য ও তাঁর মমি আবিষ্কারের জনপ্রিয় কাহিনি এই বালক ফারাওকে সবচেয়ে বিখ্যাত করে করেছে। তুতান খামিনের সমাধিক্ষেত্র থেকে তুলে আনা ঐশ্বর্য রয়েছে এই গ্যালারিতে। তাঁর ১১ কেজি ওজনের বিখ্যাত সোনার মুখোশ, নানা অলংকার, সোনায় মোড়ানো সিংহাসন, চেয়ার, পালঙ্ক, টেবল, সোনার আর সোনায় মোড়ানো দু’টি সার্কোফেগাস সবই প্রদর্শিত হয়েছে এখানে। তিনটি সার্কোফেগাসের মধ্যে রাখা ছিল তাঁর মমিটি। লাক্সারের সমাধিক্ষেত্রে সেটি রাখা আছে এখনও, ওই তৃতীয় সার্কোফেগাসের মধ্যেই। একদম শেষে গেলাম মৃদু আলোয় সাজানো, গা ছমছমে মমি ঘরে। প্রায় দশ বারোটা মমি পর পর শোয়ানো। যদিও বেশির ভাগটাই পাতলা কাপড়ে ঢাকা তবু তাদের চুল, নখ, কানের ফুটো এখনও লক্ষ করা যায়।
আসওয়ান ও লাক্সারের মধ্যে নীল নদে নানা রকম বিলাসবহুল নৌ-সফরের বন্দোবস্ত আছে। নীল নদকে প্রাণ ভরে উপভোগ করতে আমরা চেপে বসলাম মজিতো জাহাজে। ১৮৫ কিলোমিটার দূরে লাক্সার পর্যন্ত যাওয়ার পথে জাহাজ যাবে কোম ওম্বো, এডফু এবং এসনা। থাকা ছাড়াও সমস্ত রকমের আতিথেয়তা এবং সাইট সিইং ‘ক্রুজ প্যাকেজ’-এর অন্তর্গত। দু’দিকে ন্যাড়া পাহাড় আর বালিয়াড়ির মধ্যে দিয়ে চলে গেছে নীল নদ, তার পাশে পাশে রেললাইন আর রাস্তা অপূর্ব মায়াবী বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে।
বিকেলে এলাম এডফু— আসওয়ান থেকে একশো কিলোমিটার দূরে। নীল নদের ধারে সুন্দর শহর এডফু। এখানে রয়েছে হোরাসের মন্দির। হোরাস সেই আইসেস ও ওসিরিসের সন্তান। তিনি আকাশের দেবতা, তাঁর মুখ বাজপাখির মতো। হোরাসই সম্ভবত প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে পরিচিত দেবতা। হোরাসের মন্দিরের তোরণটি ৩৬ মিটার উঁচু। এর দু’পাশে রয়েছে কালো গ্র্যানাইটের তৈরি দু’টি বিশালাকার হোরাসের মূর্তি। মন্দিরের দেওয়ালের ছবিতে হোরাস ও সেথের যুদ্ধের বর্ণনা রয়েছে— যেখানে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে হোরাস সেথকে পরাজিত ও বন্দি করছে। এডফু থেকে লাক্সার আসতে এসনা-লক পার হতে হল। বিকেলের সূর্য ডুবে যাবার পরেও সূর্যাস্তের রং তখন আকাশ আর নীল নদকে ভরিয়ে রেখেছে। এসনা ড্যামের এক প্রান্তে জাহাজ যাওয়ার জন্য একটা ছোট পরিসর খোলা থাকে। সেখানে ড্যামের দু’দিকের অসমান জলতলের মধ্যে জাহাজ চলাচলের জন্য বানানো হয়েছে এসনা লক। আমরা স্রোতের অনুকূলে এলাম, উপর থেকে নীচে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে জাহাজটি সরু পরিসরের মধ্যে দিয়ে দু’পাশের দেওয়ালের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে লক ছেড়ে বেরল। কেবিনের মধ্যে তখন এক রূদ্ধশ্বাস অনুভূতি। উপরের সান ডেক থেকে অবশ্য সম্পূর্ণ পর্বটা বেশ উপভোগ করা যায়। লকের ধারে দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাচ্চা ছেলেদের কিছু বিক্রিবাটাও করতে দেখা গেল। জাহাজ থেকে পয়সা ছোঁড়া হচ্ছে, আর পাড় থেকে চলে এল মনের মতো জিনিস। মাঝরাতেই জাহাজ পৌঁছল লাক্সার। কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়ার পরে এটি মিশরের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এখানে ট্র্যাফিকের যন্ত্রণা নেই। এখানেই ছিল প্রাচীন শহর থিবেস— মধ্য সাম্রাজ্যের সময়কার মিশরের রাজধানী। লাক্সারের নীল নদে ভেসে থাকে ছোট ছোট পালতোলা নৌকা, ফেলুকা— নীলের একান্ত নিজস্ব বিষয়। ফেলুকায় চেপে নদ পার হয়ে দেখে এলাম বানানা দ্বীপের এক মিশরীয় গ্রাম। খেজুর, তরমুজ আর কলা গাছে সবুজ হয়ে রয়েছে গ্রামটা। নীল নদের পূর্ব পাড়ে দু’টি বড় মন্দির আছে— কারনাক ও লাক্সার মন্দির। বিশাল এলাকা জুড়ে বানানো কারনাক সম্ভবত পৃথিবীর বৃহত্তম মন্দির। থিবান ত্রয়ী— মুট, আমুন (রে) ও খোনসু কারনাকের উপাস্য দেবতা। এর শুরু থেকে শেষ সব কিছুই বিশালাকায়। চারটি প্রধান মন্দির প্রাঙ্গন এখানে— মুট, আমুন রে, মোনটাউ ও ফারাও চতুর্থ আমানহোটেপ। লক্ষণীয় যে দেবতাদের সঙ্গে ফারাওদের মন্দিরও বানানো হত। ফারাওকে প্রাচীন মিশরীয়রা মানুষ ও দেবতার মাঝামাঝি স্থান দিত। এদের মধ্যে শুধু আমুন রের মন্দিরেই যেতে পারলাম। মন্দির ও তোরণগুলো ঘুরে ঘুরে পৌঁছলাম ‘হাইপোস্টাইল’ হলে। প্রায় ৫০০ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে ১৩৪টি অতি বিশাল স্তম্ভ দিয়ে বানানো এই হল। কিছু স্তম্ভ ২১ মিটার উঁচু। আধো অন্ধকার হলটা যেন একটা বিশাল গোলোকধাঁধা। কারনাকেই প্রথম দেখলাম প্রাচীন মিশরীয় মন্দিরের অন্যতম দর্শনীয় বস্ত— ওবেলিস্ক। একটা বিশাল ছুঁচলো চৌকোণা স্তম্ভ। সাধারণত কোনও জোড়া না দিয়ে, একটা পাথর থেকেই এই ওবেলিস্কগুলো বানানো হত। মন্দিরের মধ্যেই রয়েছে এক পবিত্র সরোবর। পুজো করার আগে এখানে শুচি স্নান করা হত। এখানকার আচারবিধির সঙ্গে ভারতীয় রীতির বেশ কিছু মিল আছে। কারনাক মন্দিরের সঠিক নির্মাণ ইতিহাস জানা কঠিন। এর কাজ সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-এ শুরু হয়েছিল। পরে দ্বিতীয় রামসিস, তৃতীয় তুতমোসিস এবং আরও প্রায় ত্রিশ জন ফারাও এই মন্দিরের নির্মাণ ও সম্প্রসারণ চালিয়ে যান। |
||||
|
||||
বিকেলে এলাম লাক্সার মন্দিরে। ফারাওদের সময়ে কারনাক থেকে লাক্সারের মন্দির পর্যন্ত একটা রাজপথ বানানো হয়েছিল, যার দু’পাশে ছিল সারি সারি স্ফিংসের মূর্তি। অতি চমৎকার দেখতে এই স্ফিংস অ্যাভিনিউ। বহু কাল মাটি চাপা পড়ে থাকায় পুরো পথটা এখন আর দেখা যায় না। তবে খনন আর পুনর্স্থাপনের কাজ চলেছে জোর কদমে। কারনাকের মতো লাক্সারও মূলত থিবান ত্রয়ীর মন্দির। পরবর্তী কালে মন্দিরের মধ্যেই আবু-আল-হাজ্জাজ মসজিদ বানানো হয়েছিল। সম্ভবত মসজিদ বানানোর সময় মুসলমানরা মাটির তলায় চাপা পরে থাকা লাক্সার মন্দিরের অস্তিত্বর কথা জানত না।
সন্ধ্যায় মন্দিরটা অপরূপ আলোর সাজে সেজে উঠল— সে দৃশ্য সুন্দর, অতি সুন্দর! পর দিন চললাম নীল নদের পশ্চিম পাড়ে ‘ভ্যালি অব কিংস ও কুইনস’ দেখতে। এক সময় ফারাওরা মনে করল পিরামিড বানাতে প্রচুর অর্থ, সময় ও লোকবলের অপচয় হচ্ছে। তাই আর পিরামিড নয় এখন থেকে মমিকে মাটির তলাতেই কোথাও লুকিয়ে রাখা হবে। কোথায় সেই জায়গা যেখানে মৃত ফারাও শান্তিতে থাকতে পারবে? চোর-ডাকাত বা অন্য কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না। তখন খুঁজে বার করা হল ‘ভ্যালি অব কিংস’। মরুভূমির পটভূমিকায় একগুচ্ছ কঠিন বাদামি পাহাড়। তার মাঝে এই শুষ্ক উপত্যকা। কোথাও কোনও গাছ নেই, ঘাস নেই, প্রাণের কোনও স্পর্শ নেই। এক মৃত্যুপুরীর চার দিকে উঁচু পাহাড় যেন জায়গাটার শান্তি আগলে রেখেছে। পাহাড়ের অদ্ভুত গাম্ভীর্যে কেমন গা ছমছম করে! এই পাহাড়গুলো মমির জন্যে কতকটা প্রাকৃতিক পিরামিডেরও কাজ করছে। রাস্তায় যেতে যেতে দেখলাম হাওয়ার্ড কার্টারের ঘর, যিনি তুতান খামিনের সমাধি খুঁজে বার করেছিলেন। ভ্যালি অব কিংসের এন্ট্রি টিকিটে যে কোনও তিনটে সমাধিক্ষেত্র দেখার অনুমতি থাকে। রক্ষণাবেক্ষণের কারণে সব সময় সব সমাধিক্ষেত্র খোলা থাকে না। তুতান খামিনের সমাধিক্ষেত্রের জন্য আলাদা টিকিট লাগে। একমাত্র তুতান খামিনের মমিটিই সমাধিক্ষেত্রে রাখা আছে, বাকি সব মমি বিভিন্ন জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনে সমাধিক্ষেত্রগুলোতে যাওয়া বেশ সহজ— চওড়া প্রবেশপথ, দু’ধারের দেওয়ালে নানা অলংকরণ, ছবি ও হিয়েরগ্লিপ্স। এত বছর পরেও ছবির রং কী অদ্ভুত রকম জীবন্ত! ভ্যালি অব কিংসের পাশেই রানি হাতসেপসুতের মন্দির। মিশরে মহিলা ফারাও বিরল, হাতসেপসুত তাই ব্যতিক্রম। কৃতি প্রশাসক ছিলেন তিনি। ফারাও হওয়ার জন্য নিজের শিশুপুত্রকেও রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই শিশুপুত্র তৃতীয় তুতমসিস বড় হয়ে রূপকথার গল্পের মতো ফিরে এসেছিলেন এবং ফারাও হয়ে তিনি মায়ের কৃতিত্বের চিহ্ন যথাসম্ভব মুছে দিয়েছিলেন। হাতসেপতুতের মন্দিরে তাই রানির অনেক ভাঙা মূর্তি দেখলাম। এখানে নাকি কারনাকের চেয়েও বড় একটা মন্দির ছিল যা নীলের বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন শুধু অতিকায় দু’টি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে— কলোসি অফ মেমনন। |
||||
|
||||
হাতসেপতুতের মন্দির দেখেই লাক্সার ছাড়লাম আমরা। ফিরে এলাম লোয়ার ইজিপ্ট, আলেকজান্দ্রিয়ায়। ভূমধ্যসাগরের তীরে ছোট্ট জায়গাটার অবস্থানের সামরিক গুরুত্ব বুঝতে পেরে আলেকজান্ডার এই শহরের পত্তন করেন। এখানেই ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম লাইব্রেরি ও বিখ্যাত বাতিঘর, যা প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। দু’টির কোনওটিই আজ আর নেই। কিন্তু মিশরীয়দের বিদ্যানুরাগের চিহ্ন এই লাইব্রেরিটির জন্য আলেকজান্দ্রিয়াকে আজও সম্মান করা হয়। পুরনো লাইব্রেরির জায়গাতেই গড়ে তোলা হয়েছে নতুন ভবন। ভেঙে যাওয়া বাতিঘরের জায়গায় বানানো হয়েছে ‘সিটাডেল অব কুইতবে’। এখানে ক্যাটাকম্ব, রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার ও পম্পেই পিলারে মূলত গ্রেকো-রোমান স্থাপত্য দেখতে পেলাম। আলেকজান্দ্রিয়াতে আছে মিশরীয়, গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয়। বিজয়ী ইউরোপ বিজিত জাতির থেকে শিক্ষা নিয়েছে আর তার স্বাক্ষর রেখে গেছে আলেকজান্দ্রিয়ার স্থাপত্যে। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে অদ্ভুত সুন্দর মরুভূমির পথ ধরে ফিরলাম কায়রো। বিমানবন্দরের পথে শেষবারের মতো দেখতে পেলাম খুফু, খাফ্রির পিরামিড গাড়ির জানালায় পিছু হটে গেল। তার পর মিশরকে বিদায় জানিয়ে চেপে বসলাম রাতের বিমানে। নীচের মরুভূমিতে নীল নদ আর ফারাওদের দেশ দূর থেকে দূরে আবছা হয়ে গেল! |
||||
গাড়ির জানালায় পিছু হটে গেল খুফু, খাফ্রির পিরামিড |
||||
|
||||
|
||||
ছবি: লেখক | ||||
রোজের আনন্দবাজার • এ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘর • স্বাদবদল • চিঠি • পুরনো সংস্করণ | ||||