এই একটা দিনই খাওয়ার ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে কোনও বাছ-বিচার থাকে না। তাই উচ্চ-রক্তচাপের রোগীও স্ত্রীকে আড়াল করে শেষ পাতে রসগোল্লা মুখে পুরে শিশুর মত হেসে ওঠেন। কেউ আবার ১১ খানা গরম বেগুনি খাওয়ার পরে পাশের বাড়ির প্রবীণের কানে কানে বলেনকথাটা যেন বাড়ি অবধি না গড়ায়। এঁদের বয়স অবশ্য ৭০ পেরিয়ে ৮০’র কোঠায়।
রবিবার ‘বহরমপুর প্রবীণ সভা’ পুরসভা কার্যালয়ের পিছনে ধোপঘাটির মাঠে প্রবীণ-প্রবীণাদের নিয়ে এক পিকনিক-এর আয়োজন করে। এদিন মাঠে হাজির ছিলেন ২২০ জন সদস্য। তাঁদের মধ্যে সত্তরোর্ধ্ব সমীরণ চৌধুরী উচ্চরক্তচাপের রোগী হওয়া সত্ত্বেও এদিন শেষ পাতে রসগোল্লা চেয়ে খান। ‘একটা মিষ্টি খেলে কিছু হবে না’ বলে বাড়তি উৎসাহ দেন অন্যরা। একই ভাবে অমিতোষ বিশ্বাস খাওয়ার শুরুতেই ১১টি বেগুনি ভাজা খেয়ে ফেলেন। যদিও ২৭টি বেগুনি খাওয়ার রেকর্ড তাঁর অক্ষতই রয়ে গেল। অমিতোষবাবুর কথায়, “অনেক দিন পরে ভাতের সঙ্গে গরম বেগুনি পেয়ে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। স্ত্রী সঙ্গে থাকলে হয়তো আমায় খেতে দিত না।” |
যদিও ভুরিভোজের আনন্দ অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় প্রবীণসভা’র কর্ণধার প্রভাত রায়চৌধুরী (৭৯)-র প্রয়াণে। প্রবীণসভার সভাপতি আলি হাসান বলেন, “শনিবার রাত দুটো নাগাদ বহরমপুর ইন্দ্রপ্রস্থের বাড়িতে মারা যান প্রভাতবাবু। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন।” মণীন্দ্রনগর বয়েজ হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রভাতবাবু প্রচেষ্টায় ১৭ বছর আগে বহরমপুর প্রবীণসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এদিন পিকনিক চলাকালিন ধোপঘাটি কার্যালয়ে প্রবীণ সভার প্রাণপুরুষ প্রভাতবাবুর মৃতদেহ নিয়ে আসা হলে সদস্য প্রবীণ-প্রবীণারা শ্রদ্ধা জানান। সেখান থেকে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শ্মশানে। প্রবীণসভার সম্পাদক অসিত বাগচি বলেন, “প্রবীণাদের জন্য আয়োজন ছিল মিউজিক্যাল চেয়ার, হাঁড়ি ভাঙা, মেমারি গেম। প্রবীণদের ২৫ মিটার হাঁটা প্রতিযোগিতা, তাস ও লুডো খেলা। ছিল গানের আসর। কিন্তু কিন্তু প্রভাতবাবুর মৃত্যুতে বিভিন্ন ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সব কিছু বাতিল করা হয়েছে। আগে থেকে সকলকে জানানো হয়েছিল বলে পিকনিক বাতিল করা সম্ভব হয়নি।”
বহরমপুর প্রবীণসভার ধোপঘাটি কার্যালয়টি জেরিয়াট্রিক কেয়ার সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সেখানে মানসিক-সাধারণ চিকিৎসা ছাড়া চক্ষু বিভাগ ও ফিজিওথেরাপি হয়ে থাকে। ২০০৫ সালে ওই সেন্টারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালিন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী। পরে ওই ভবনের তিন তলায় একটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ে ওঠে। ওই বৃদ্ধাশ্রমে এক দম্পতি-সহ ৮ জন রয়েছেন। অন্যদের সঙ্গে পিকনিকে এদিন তাঁরাও সামিল হন। এই দিনটি তাঁদের কাছে অন্য রকম বার্তা বয়ে নিয়ে আসে।
৭৫ বছরের সুফলা দত্ত বলেন, “এখানে তো একাই পড়ে রয়েছি। এই দিনটা তাই আমার কাছে বিশেষ দিন।” ৮৫ বছরের খুদুরানি বিশ্বাস যেমন মুর্শিদাবাদ জেলাপরিষদে কর্মরতা অবিবাহিতা ছোট মেয়েকে নিয়ে এখানে রয়েছেন। তেমনি রয়েছেন নিঃসন্তান ভট্টাচার্য দম্পতি। স্ত্রী মিনতি ভট্টাচার্য পলাশির গোবিন্দসুন্দর প্রাথমিক স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা আর স্বামী তরুণ ভট্টাচার্য বহরমপুর বাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের করণিক। পিকনিকের টানে মাঠে হাজির হন বাণী মজুমদার, লক্ষ্মী বন্দোপাধ্যায়, দেবী ঠাকুর, শৈলেন্দ্রকুমার আচার্য, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ-প্রবীণারা। একে-অপরকে দেখে জড়িয়ে ধরে কারও জিজ্ঞাসা‘বাতের ব্যথা ভাল আছে তো?’ কেউ বলছেন, ‘শুনলাম ঠান্ডায় তোমার হাঁপানিটা একটু বেড়েছিল?’ |