শীতের রাতে দরদর করে ঘামছিলেন ষষ্ঠী মণ্ডল। শনিবার রাতে ফুলিয়াতে আপ ও ডাউন শান্তিপুর লোকালের মুখোমুখি ধাক্কার পরে একের পর এক আহত যাত্রীকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ফুলিয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছেন তাঁর রিকশায় করে। সামান্য বিশ্রাম নেওয়ারও সুযোগ ছিল না তাঁরই মতো ছিদাম ঘোষ বা রতন ঘোষেরও। দুর্ঘটনার পরে তাঁদের মতো এলাকার অনেকেই প্রথমে দু’টি ট্রেনের কামরায় ঢুকে আহত যাত্রীদের উদ্ধার করেন। তার পরে নিজেদের উদ্যোগেই তাঁদের নিয়ে যান স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
ওই রাতে স্টেশন চত্বর তখন গমগম করছিল। আপ শান্তিপুর লোকাল সবে এসে দাঁড়িয়েছে। ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম যেখানে শেষ, ঠিক তার পরেই লাইনের ধারেই বসে সব্জি বাজার। সেখানেও লোকজম কম ছিল না। ষষ্ঠী তখন সবে তাঁর রিকশার যাত্রীকে ডাউন শান্তিপুর লোকাল ধরানোর জন্য শেষ কিছুটা রাস্তা প্রাণপণে চালিয়ে নিয়ে এসেছেন। তাই ভাড়াও একটু বেশিই চেয়েছিলেন। তাই নিয়েই কথা কাটাকাটির মধ্যে দেখলেন, আপ ট্রেনটির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা লাগল ডাউন ট্রেনটির। প্রচণ্ড শব্দ। ধোঁয়ায় ভরে গেল চারপাশ।
ষষ্ঠীবাবু এত ক্ষণের বিবাদ ভুলে ভাড়া না নিয়েই ছুটেছিলেন স্টেশনে। ডাউন ট্রেনটির প্রথম কামরা থেকে হাত লাগিয়ে বার করে এনেছিলেন কয়েকজনের দেহ। ছিদাম বলেন, “দু’টো ট্রেন প্রায় একই সময় আসে বলে এই সময়টা অনেক যাত্রী মেলে। তাই আমরাও রিকশা নিয়ে চলে আসি। কিন্তু ওই ঘটনার পরে কারওরই আর নিজেদের কথা মনে ছিল না। শুধু ভাবছিলাম, আহতদের তাড়াতাড়ি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারলে হয়তো তাঁরা প্রাণে বেঁচে যাবেন।” মাত্র কয়েক মিনিট আগে এক টাকার জন্য যে ষষ্ঠীবাবু তর্ক করছিলেন তাঁর রিকশার যাত্রীর সঙ্গে, তিনি বলেন, “দুর্ঘটনার পরে ভাড়া কে দেবে, সে কথা কী কেউ ভাবে?”
পাশের সব্জি বাজার থেকে চলে এসেছিলেন সমীর মজুমদার। তিনি কয়েকজনকে নিয়ে ডাউন ট্রেনটির চালকের কামরায় উঠে পড়েন। তাঁরা কোনওরকমে ঢুকে জানলা দিয়ে বার করে আনেন ওই চালক আর এস যাদবকে। তিনি বলেন, “বার করে আনার পরেই চালক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তারপরে তাঁকে পুলিশের গাড়িতে করে শান্তিপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।”
স্টেশনের পাশেই চায়ের দোকান মন্মথ দাসের। এক এক করে আহতদের স্টেশন থেকে নিয়ে এসে রিকশায় তোলার সময় তাঁদের চোখেমুখে জল দেওয়ার প্রাথমিক কাজটুকু করেছিলেন তিনিই। সঙ্গে ছিলেন ওই চত্বরেরই আর এক ব্যবসায়ী রাম শর্মাও। মন্মথবাবু বলেন, “এত বড় দুর্ঘটনা আমাদের এখানে কখনও হয়নি। প্রথমে সবাই একটু চমকে গিয়েছিলাম। তারপরেই বুঝতে পারলাম ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।” রাম শর্মার কথায়, “আমরা নিজেরাই কী করে যেন কাজ ভাগ করে নিয়েছিলাম। কেউ আহতদের বার করে আনছিলেন, কেউ তাঁদের ভ্যানে বা রিকশায় তুলছিলেন। আমরা প্রাথমিক ভাবে যতটুকু শুশ্রূষা করা যায়, তার চেষ্টা করছিলাম।”
রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান বিনয় মিত্তল রবিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে বলেন, “স্থানীয় বাসিন্দারা যে ভাবে এগিয়ে এসেছিলেন, তা খুবই প্রশংসনীয়।” দুর্ঘটনায় আহত শান্তিপুরের বাসিন্দা জয়দেব মণ্ডল বলেন, “স্থানীয় লোকজনই আমাকে কামংরা থেকে উদ্ধার করেন। তারপরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে দেখলাম, তাঁরাই সযত্নে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন।” |