বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয় নিয়ে আত্মবিশ্লেষণ চলছে সিপিএমে। এই পরাজয় নিয়ে এ বার বড় শরিকের উপরেই দায় চাপাল আরএসপি-ও। শনিবার থেকে শুরু হয়েছে আরএসপির দু’দিনের চতুর্দশ জেলা সম্মেলন। সেই উপলক্ষে প্রকাশিত সম্পাদকীয় খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এমনটাই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রধান শরিক দল প্রায় ক্ষেত্রেই নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে যে ভাবে প্রশাসনকে কুক্ষিগত করেছিল এবং ফ্রন্টের ভেতর ও জনসাধারণের সামনে ‘এক ও অদ্বিতীয়’ শক্তি হিসেবে সংকীর্ণ মনোভাব নিয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করে চলেছিল, তাতে শরিক দলগুলি এবং সাধারণ মানুষের মধ্য বিস্তর ক্ষোভ ধূমায়িত হয়েছিল। এই সব নানা ঘটনার ফলে অনেক আগে থেকেই বামফ্রন্টের জনসমর্থনের ভিত ক্ষয় শুরু হয়েছিল। সেই সঙ্গে দম্ভ, অহঙ্কার, দুর্নীতি, পেশিশক্তি ও প্রশাসনকে ব্যবহার করার অভ্যাস ভালরকম দানা বেঁধেছিল।’
নন্দীগ্রাম-উত্তর পর্বে রাজ্যের তৎকীলান পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামী প্রকাশ্যেই সিপিএমের তীব্র সমালোচনা শুরু করেন। এর জেরে বামফ্রন্টের দুই শরিকের মধ্যে মন কষাকষিও হয়েছিল। আরএসপি-র ত্রয়োদশ জেলা সম্মেলনে এই ‘ক্ষিতি লাইনে’র বিরোধিতা করা হয়েছিল। সেই সম্মেলনের সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে দলের জেলা সম্পাদক অঞ্জন মুখোপাধ্যায়ই সিপিএমের সঙ্গে ‘নিবিড় সংযোগ’ এবং ‘সহযোগিতা’র কথা বলেছিলেন। ওই সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘সিপিএমের সমালোচনা করার আগে দলের মন্ত্রীরা কেন দলের ভেতর সেই বিরোধিতার কারণ নিয়ে আলোচনা করেননি। অবিলম্বে এ সব বন্ধ করা হোক।’
বিধানসভা নির্বাচনে ফলাফল প্রকাশের পরেই কেন হারের কারণ হিসেবে সিপিএমকে দায়ী করা হচ্ছে?
অঞ্জনবাবুর জবাব, “ওই দলের সঙ্গে আমরা সমস্ত নির্বাচনী সভা আর বৈঠক করেছি। কিন্তু বার বার আবেদন করা সত্ত্বেও বিধানসভা ভোটে জেলায় ওরা আমাদের একটি আসনও ছাড়েনি। আমাদের যখন কোনও প্রার্থীই ছিলেন না, তখন এই পরাজয়ের দায় আমার নেব কেন?”
নিষ্ক্রিয়তার কারণে আরএসপি-র মোট ১১০ জন সদস্যকে জেলা সম্মেলনের আগে বহিষ্কার করা হয়েছে। সিপিএমের খণ্ডঘোষ জোনাল কমিটির প্রাক্তন সদস্য ওমর আলিকে আরএসপিতে সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে। তাঁকে খণ্ডঘোষ জোনালের সম্পাদকও মনোনীত করেছেন আরএসপি নেতৃত্ব।
আরএসপি-র এই প্রতিবেদনে জমি অধিগ্রহণ প্রশ্নেও সিপিএমের সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “শিল্পায়ন ও জমি অধিগ্রহণের বাস্তব প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি কৃষিজীবী জনসাধারণ ও নাগরিক সমাজকে ভালভাবে না বুঝিয়ে, প্রশাসন ও দলের মাত্রাতিরিক্ত আচরণে ‘জমি অধিগ্রহণও’ বামফ্রন্ট সরকার ও তার দলের জনভিত ধ্বসিয়ে দিয়েছিল।”
আরও বলা হয়েছে, ‘শিল্পায়নের জন্য তাড়াহুড়ো করে ‘এসইজেড বিল’ একতরফা ভাবে পাশ করানো, শরিকদের মতামত উপেক্ষা করে নন্দীগ্রামের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটানো, কেমিক্যাল হাব গড়ার উদ্যোগ, পারমাণবিক শক্তির প্ল্যান্ট তৈরির উদ্যোগ অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল।’ আরও দাবি, ‘এই কারণেই তৃণমূলের আন্দোলন দানা বাধে। নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের, নাগরিক সমাজে বামফ্রন্ট সম্পর্কে বিরূপতা ও বিতশ্রদ্ধ মনোভাব তৈরি করে। এই মনোভাবই গত পঞ্চায়েত, লোকসভা, পৌরসভাগুলির নির্বাচনে বামফ্রন্টকে হারাতে শুরু করে। তাই এ বারের বিধানসভা ভোটে ফ্রন্টের ভরাডুবি ছিল প্রায় অবধারিত ঘটনা।’
সিপিএমের বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক অমল হালদার বলেছেন, “আরএসপি বামফ্রন্টের শরিক দল। তাদের নিজেদের মতো করে মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। ওঁরা সেটাই করেছেন। ওঁদের মতামত সম্পর্কে আমরা আর কী বলব?”
সিপিএমের জেলা কমিটির সাম্প্রতিক রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্টে অবশ্য বেশ পরিষ্কারই বলা হয়েছে, ‘আরএসপি দলের ক্ষমতা কয়েকটি পকেটে সীমাবদ্ধ। তবে পার্টির (সিপিএমের) ভাবমূর্তি ক্ষুন্নকারী যে অংশগুলিকে আমরা বহিষ্কার বা খারিজ করেছি, (আরএসপি) তাঁদের দলে নেবার চেষ্টা করছে। সেই অংশের মূল লক্ষ্য তৃণমূল কংগ্রেসে যুক্ত হওয়া। কিন্তু বর্তমানে আরএসপি দলটিকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে।’ |