কোমায় হাসপাতাল ৩...
এক হাতে মোমবাতি, অন্য হাতে
সিরিঞ্জ নিয়ে রোগী খোঁজেন নার্স
ন্ধকারে গোটা হাসপাতাল। রোগীরা ছটফট করছেন। রোগীদের আত্মীয়রা রাগে-ক্ষোভে চিকার করছেন। আর ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গলের মতো এক হাতে মোমবাতি আর অন্য হাতে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ নিয়ে ছোটাছুটি করছেন নার্সরা। তবে তাঁরাও উত্তেজিত। ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেলের মতো ধৈর্য তাঁদের নেই। যন্ত্রণায় কোনও রোগী বেশি কাতরালে তাঁর কপালে জুটছে দেদার ধমক। ব্যারাকপুর বি এন বসু মহকুমা হাসপাতালের এই চিত্রটা নতুন নয়। কারণ হাসপাতালের জেনারেটরটি পুরনো। লোডশেডিংয়ের মাত্রা যত বাড়ে তত প্রকট হয় হাসপাতালের অন্ধকারে ডুবে থাকার সমস্যা। পনেরো বছরের পুরনো জেনারেটর মাঝে মাঝেই নিজের অক্ষমতা জানান দেয়। জেনারেটর সারানোর দায়িত্ব যাঁর, তিনি থাকেন বালিতে। ট্রাফিক জ্যাম, রাস্তা খারাপ ইত্যাদি নানা অজুহাতে তাঁর হাসপাতালে পৌঁছে জেনারেটর সারাতে সারাতেই কখনও কখনও কারেন্ট চলে আসে।
জেনারেটরের মতোই বেহাল অবস্থা হাসপাতালের জল তোলার পাম্পটিরও। সেটিও পুরনো। বিকল্প একটি পাম্প থাকলেও মাঝে মাঝে দু’টোই একসঙ্গে খারাপ হয়। পূর্ত বিভাগের কর্মীরা জানান, যতই হোক যন্ত্র তো। কখন বিকল হবে সে কি আর বলা যায়? কিন্তু হাসপাতাল তো হোটেল নয়। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের সবথেকে ব্যস্ত হাসপাতাল এটি। রাত-দিন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীর ভিড়। দুর্ঘটনাগ্রস্থ, অসুস্থ রোগীরা জরুরি চিকিসার জন্য বহু দূর থেকে ছুটে আসেন। শিল্পাঞ্চলের ছোট হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো থেকেও রোগীদের রেফার করা হয় এখানে। কিন্তু কতটা পরিষেবা পান রোগীরা?
নিজস্ব চিত্র
আড়াইশো শয্যার এই মহকুমা হাসপাতালে পরিকাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি প্রকট ওষুধ ও চিকিসার সরঞ্জাম ঘাটতি ও চিকিৎসাকর্মীর অভাব। আর এই কারণেই চিকিৎসার আশায় আসা রোগীরা এখান থেকেও রেফার হয়ে যান অন্য জায়গায়। বহু ক্ষেত্রে রোগীর আত্মীয়রাও ভরসা পান না ‘নেই চিকিৎসা’র হাসপাতালে নিজের প্রিয়জনকে ফেলে রাখতে। সাতজন শল্য চিকিসকের মধ্যে তিনজনই অবসর নেবেন নতুন বছরে। এর মধ্যে অর্থোপেডিক বিভাগটির অবস্থা শোচনীয়। একজন শল্য চিকিসক ডেপুটেশনে থাকলেও অপারেশনের জন্য আসা বেশিরভাগ রোগীকেই রেফার করা হয়। দু’-দুটো এক্স-রে মেশিন খারাপ হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। একটি মেশিন চালু থাকলেও কর্মীর অভাবে সেটির পরিষেবাও সব সময় মেলে না রোগীদের। ফলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাইরে থেকে বেশি টাকা দিয়ে এক্স-রে করাতে হয় বলে রোগীদের অভিযোগ।
শুধু এক্স-রেই নয়, অপারেশনের সূচ, সুতো, এমনকী গজ, তুলোও এখন অমিল বি এন বসু হাসপাতালের ভাঁড়ারে।
বি এন বসু হাসপাতালে সব রকম রোগীর ভিড় থাকলেও প্রসূতি বিভাগে চাপ সবথেকে বেশি। গত নভেম্বর মাসের হিসাব অনুযায়ী এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগীর সংখ্যা ৬২৯। এর মধ্যে প্রসূতির সংখ্যাই প্রায় ৪০০। এক মাসে প্রসূতি বিভাগ থেকে কলকাতায় রেফার হয়েছেন ১০ শতাংশ রোগী। বাকিদের এই হাসপাতালে প্রসব হলেও মায়েদের আয়রন ও ফলিফার ট্যাবলেট কিনতে হয়েছে বাইরে থেকে।
প্যাথলজিস্ট না থাকায় রক্ত, মল-মূত্র পরীক্ষা বন্ধ। ডারমাটোলজি বিভাগটিও দীর্ঘদিন বন্ধ। শিল্পাঞ্চলের দূষণে চামড়ার রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। তাই এই বিভাগটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একাধিকবার চিঠি-চাপাটিও হয়েছে। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, রেফারের মূল কারণ হল এইগুলিই। হাসপাতালের সুপার মৃদুল ঘোষ বলেন, ‘‘কি ভাবে যে হাসপাতাল চলছে তা আমরাই জানি। সমস্যার কথা বার বার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। রোগী কল্যাণ সমিতির বৈঠকে সে সব নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু সমস্যা মেটেনি। উল্টে ধার করে বাইরে থেকে ওষুধ কিনেও রোগীদের অসন্তোষ সামলেছি। আমরা তো পরিষেবা দিতে চাই। কিন্তু এত প্রতিবন্ধকতা থাকলে কী করে তা সম্ভব?’’
চিকিসক ও নার্সের অভাবে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বহু ক্ষেত্রে তাঁদের হয়ে ঠেকা দেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা। এখানেও তার ব্যাতিক্রম নয়। কিন্তু এর ভয়ঙ্কর পরিণতিও সামলাতে হয়েছে কিছুদিন আগে। এক রোগীকে অক্সিজেন দিয়েছিলেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। কিছুক্ষণ বাদেই অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তা খেয়াল করেননি কেউ। রোগীর আত্মীয়রা মারধরও করেন ওই কর্মীকে।
চারতলা হাসপাতালে লিফট মাত্র একটি। সেটি বিকল হলে রোগীকেও সিঁড়ি দিয়েই তোলা-নামানো হয়। হাসপাতালে সদ্য রঙ করা দেওয়ালে পানের পিক, থুথু। মৃদুলবাবু বলেন, ‘‘এমনিতেই শিল্পাঞ্চচলে মানুষের সচেতনতার অভাব। হাসপাতালে সন্ধ্যার পরে নেশাগ্রস্তদের আনাগোনা বেড়ে যায়। আমাদের এখানে কোনও নিরাপত্তা নেই। বারবার পুলিশের কাছে একটা আউট পোস্টের জন্য জানাচ্ছি। কারও কোনও উদ্যোগ নেই। কিন্তু কোনও ঘটনা ঘটলে তখন হাসপাতালের দায়।’’ ২৯জন সাফাই কর্মীর মধ্যে এখন ১৯ জন আছেন। তার মধ্যে তিনজন কোনও কাজ করেন না বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই স্বাস্থ্য দফতরে অভিযোগ করেছিলেন।
তবে অভিযোগই সার। এরকম ভাবেই চলছে মহকুমা হাসপাতাল। কাগজে-কলমে বিস্তর অভিযোগ, চিঠি চালাচালি। ব্যাস ওইটুকুই। বেহাল স্বাস্থ্য সারে কই!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.