পশ্চিমবঙ্গে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল করা নিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূলের ‘তিক্ততা’ এ বার পৌঁছল প্রধানমন্ত্রীর দরবারে।
বহু ‘ব্র্যান্ডের’ খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে ধাক্কা খাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ইউপিএ-র প্রধান শরিক তৃণমূলের সঙ্গে ‘সমন্বয়’ আরও বাড়ানোর কথা বলছেন ঠিকই। কিন্তু রাজ্য স্তরে কংগ্রেস-তৃণমূলের চূড়ান্ত ‘তিক্ততা’ ফের প্রকাশ্যে এল বৃহস্পতিবার, যখন প্রধানমন্ত্রীর দরবারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ‘প্রকারান্তরে’ নালিশই জানিয়ে এলেন কংগ্রেস সাংসদ দীপা দাশমুন্সি, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল। যার ‘পাল্টা’ হিসেবে আজ, শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবে তৃণমূল সাংসদদের এক প্রতিনিধি দল।
এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল দক্ষিণবঙ্গের নদিয়া জেলার কল্যাণীতে করার জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। গত অক্টোবরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী গুলাম নবি আজাদকে চিঠি দেন মমতা। কিন্তু ওই হাসপাতাল উত্তর দিনাজপুরে তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্র রায়গঞ্জে করতে হবে বলে গোড়া থেকে বলে আসছেন দীপা। নচেৎ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছেন দীপা। প্রদেশ কংগ্রেসও তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁদের যাওয়াও সেই কারণেই। উত্তরবঙ্গের সাংসদ ও বিধায়কদের অনেকেই তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর দীপা সরাসরি বলেন, “রাজ্য বলছে রায়গঞ্জে জমির অভাব রয়েছে। তা সত্যি নয়। মুখ্যমন্ত্রী পরস্পরবিরোধী কথা বলছেন। অথচ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী চিঠি লিখে আমায় জানিয়েছেন কল্যাণী নয়, হাসপাতাল হবে রায়গঞ্জেই। তিনি নিজে মুখ্যমন্ত্রীকে জমির জন্য চিঠি লিখেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই বিষয়টি আটকে রয়েছে।’’ রায়গঞ্জের সাংসদের আরও অভিযোগ,“প্রধানমন্ত্রী বা প্রণববাবুর কাছে সময় চাইলে তাঁরা সময় দেন। কিন্তু মমতার কাছে সময় চেয়েও পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকবার চিঠি লেখা হয়েছে। জবাব পর্যন্ত আসেনি!” প্রদীপবাবু বলেন, “আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি রায়গঞ্জে ওই হাসপাতাল করার দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের। আর কোনও জায়গার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। কল্যাণীতে অন্য হাসপাতাল হতেই পারে। কিন্তু এইমস হলে তা রায়গঞ্জেই হবে।” প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, রায়গঞ্জে হাসপাতালটি না-হলে উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছে ‘ভুল বার্তা’ যাবে। প্রদীপবাবু জানান, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি কথা বলবেন প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রত্যাশিতভাবেই ঘটনাপ্রবাহে ‘ক্ষুব্ধ’ তৃণমূল। লোকসভায় দলের নেতা ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন,“যাঁরা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন, তাঁরা জেনে রাখুন মনমোহন সিংহের কাছে যাওয়ার সুযোগ আমাদেরও রয়েছে। শুক্রবার আমরাও ওঁর সঙ্গে দেখা করে বলব, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে অশান্তি তৈরি করা হচ্ছে। রাজ্য সরকারের ঘোষিত নীতি জমি অধিগ্রহণ না-করা।” তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার সরাসরি দীপাকে কটাক্ষ করে বলেন, “উনি রাজনৈতিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। উনি মাঝে মাঝে সকালে হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে গেলে দেখবেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে হাজার-হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মহাকরণে যাওয়ার আগে অন্তত পাঁচশো মানুষের সঙ্গে দেখা করে তাদের সমস্যা শোনেন। এর পরেও যদি তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা যায় না, তা হলে উনি মিথ্যা বলছেন!” রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বের আবার বক্তব্য, দিল্লিতে সমন্বয় কমিটি নেই বলে তৃণমূল সর্বদা অভিযোগ করছে। কিন্তু রাজ্যে সমন্বয় কমিটি থেকেও শরিকদের মধ্যে কোনও সমন্বয় নেই। তৃণমূল দিল্লিতে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি নয়।
মমতা কল্যাণীতে কেন ওই হাসপাতাল করতে চান, তা জানিয়ে তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “উত্তরবঙ্গে একের জায়গায় চারটি হাসপাতাল হলেও আমাদের আপত্তি নেই। প্রশ্নটা হচ্ছে জমি পাওয়া নিয়ে। রাজ্য সরকারের ঘোষিত নীতি হল, কোথাও বলপূর্বক জমি, বিশেষত কৃষিজমি নেওয়া হবে না।” ওই নেতার বক্তব্য, রায়গঞ্জে হাসপাতালটি করতে হলে বেশ কিছু পরিমাণ বহুফসলি জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। কল্যাণীতে হলে সেই সমস্যা নেই বলেই তাঁদের দাবি। গুলাম নবির কাছে মমতা প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, পর্যায়ক্রমে রায়গঞ্জ, শিলিগুড়ি, মালদহ, বালুরঘাট এবং মুর্শিদাবাদেও একই উন্নত মানের হাসপাতাল তৈরি হোক। কল্যাণীতে হাসপাতালের জমি সহজে জমি পাওয়া ছাড়াও বর্তমান পরিকাঠামো কাজে লাগিয়ে অত্যাধুনিক হাসপাতাল গড়া সম্ভব বলে মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী।
দীপার অবশ্য দাবি, রায়গঞ্জে হাসপাতালের জন্য ইতিমধ্যেই ৮৫ শতাংশ জমি অধিগৃহীত হয়ে গিয়েছে। বেশির ভাগ জমিই খাস। তাঁর বক্তব্য, “প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি রায়গঞ্জের সাংসদ থাকাকালীন ২০০৯ সালেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে ওই হাসপাতাল খোলার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। কেন্দ্র অর্থও বরাদ্দ করেছে।” ইতিমধ্যেই ওই ধরনের হাসপাতাল তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে যোধপুর, পটনা, হৃষিকেশ, ভোপাল, রায়পুর এবং ভুবনেশ্বরে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, এর মধ্যে উত্তরাখণ্ডের হৃষিকেশে সবচেয়ে দ্রুত কাজ হচ্ছে। সুদীপবাবু জানিয়েছেন, দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী
পরিকল্পনায় উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে ওই হাসপাতাল তৈরির প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। তাঁর কথায়, “যেখানেই হাসপাতাল হোক, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে রাজ্য সরকারের অবস্থান সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার ওয়াকিবহাল।”
তবে আপাতত ওই হাসপাতাল হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজ্যের জোট সরকারের দুই শরিকের রাজনৈতিক ‘শক্তি যাচাই’য়ের মঞ্চ। শেষ পর্যন্ত কোন জেলার শিকে ছেড়ে, সেটাই দেখার! |