আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় ক্রমশ জটিল হচ্ছে মহানগরীর ডেঙ্গি-চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি।
রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমলেও জীবাণু যে আরও সক্রিয় হয়েছে, রোগীর উপসর্গ দেখলেই তা বুঝতে পারছেন চিকিৎসকেরা। যেমন এত দিন নন-হেমারেজিক (যাতে রক্তক্ষরণ হয় না) ডেঙ্গির রোগী মিলছিল শহরে। কিন্তু ঠান্ডা বাড়া-কমার মধ্যে বেড়ে গিয়েছে হেমারেজিক ডেঙ্গির সংক্রমণ। জ্বর, গাঁটে ব্যথা নিয়ে যাঁরা চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন, তাঁদের একটা বড় অংশের মাড়ি, নাক, চামড়ার নীচে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অনেকের মুত্রের সঙ্গেও রক্ত বেরোচ্ছে। এগুলি যে ডেঙ্গির উপসর্গ, তা বুঝতে চিকিৎসকদের অসুবিধা হচ্ছে না।
তবে, চিকিৎসকেরা চিন্তিত নতুন ধরনের চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণে। জীবাণু বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী বলছেন, “আমি গত কয়েক দিনে বেশ কিছু চিকুনগুনিয়ার রোগী পেয়েছি, যাঁদের কানের পিছনে বা কুঁচকির গ্ল্যান্ড ফুলে গিয়েছে। ঢোক গিলতে সমস্যা হচ্ছে। জ্বর ও গাঁটে ব্যথার সঙ্গে এই সব উপসর্গ যুক্ত হওয়ায় বেড়েছে রোগীর ভোগান্তিও।” তাঁর ব্যাখ্যা, “নতুন প্রজাতির চিকুনগুনিয়া এসেছে কি না, বুঝতে পারছি না।”
নতুন ধরনের চিকুনগুনিয়া নিয়ে চিন্তিত চিকিৎসক সুব্রত মৈত্রও। তিনি বলেন, জ্বর ও গাঁটে ব্যথার উপসর্গ নিয়ে এখনও বেশ কিছু রোগী আসছেন। কিন্তু চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গি পরীক্ষা করালে নেগেটিভ আসছে। তিনি বলেন, “রোগীর ভোগান্তি বাড়ছে। চিকিৎসকেরাও খানিকটা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। সম্ভবত এটা নতুন ধরনের চিকুনগুনিয়া, যার সঙ্গে আমরা পরিচিত নই।”
তবে শিশুদের মধ্যে ডেঙ্গি-চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ অনেকটা কমেছে বলে মন্তব্য করেছেন শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ। তিনি বলেন, “বহু ক্ষেত্রে উপসর্গে মিল দেখে চিকিৎসকেরাও বলে দিচ্ছেন, ডেঙ্গি বা চিকুনগুনিয়া হয়েছে। আদতে কিন্তু তা নয়। রক্ত পরীক্ষা করলে নেগেটিভ আসছে। এখন সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশিই বেশি।” জীবাণু বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, আবহাওয়া কিছুটা স্থিতিশীল হলে এ সব রোগ কমবে।
শুধু রোগজীবাণু জটিল হওয়াই নয়, ওষুধ বিভ্রাটেও রোগীদের ভোগান্তি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অমিতাভবাবু। তিনি বলেন, “এমন অনেক রোগী পাচ্ছি, যাঁদের ওষুধে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। কিছু কিছু রোগী কড়া ডোজের অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে স্টেরয়েড খেয়েছেন। তাতে তাঁদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। যে রোগ প্যারাসিটামল এবং স্টেরয়েড-বিহীন ব্যথার ওষুধেই নিরাময় হয়, সেখানে অপ্রয়োজনীয় ওষুধে রোগ আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। জীবাণুও মরছে না।”
কলকাতা পুরসভা কিন্তু এ সব নিয়ে এতটুকুও উদ্বিগ্ন নয়। বরং মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ বলছেন, “এ বার শহরে মশাবাহিত রোগের প্রকোপ কমেছে। তাই এক শ্রেণির চিকিৎসব অজানা জ্বর নিয়ে ‘গেল গেল’ আওয়াজ তুলছেন। এ সবই করা হচ্ছে নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে।” মেয়র পারিষদ আরও বলেন, “কোনও কোনও ডাক্তার নিজেদের মতো করে জ্বরের চিকিৎসা করছেন। এটা ভয়ঙ্কর। অনেক ডাক্তার স্টেরয়েডও দিচ্ছেন। কিন্তু পুরসভা থেকে নির্দিষ্ট ভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনও ওষুধ খাবেন না। জল খান বেশি করে।”
মশাবাহিত রোগ এ বার কমেছে বলে মেয়র পারিষদ ‘আত্মসন্তুষ্টিতে’ ভুগলেও স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন, স্বাস্থ্যভবন এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজের জীবাণু বিশেষজ্ঞেরা কেউ কেউ জানাচ্ছেন, শহরে কী কী ধরনের মশা রয়েছে, অবিলম্বে তা নিয়ে সমীক্ষা করা উচিত পুরসভার। মশাই নানা ধরনের জ্বরের জীবাণু বহন করছে। যে ভাবে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া সারা বছর ধরে দফায় দফায় হচ্ছে, তা নিয়ে সবিস্তার গবেষণার উপরেও জোর দিয়েছেন চিকিৎসক-গবেষকেরা।
|
মনে রাখুন |
• চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ নয়
• ব্যথা কমাতে স্টেরয়েড কখনওই নয়
• সাধারণ প্যারাসিটামলেই রোগ নিরাময় হয়
• বার বার বেশি করে জল খান
• মশা তাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন |
|