কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি-র আগে একটা ইঞ্জেকশন! সেটাই
হয়তো হয়ে উঠতে পারে ক্যানসারের চিকিৎসাকে কার্যকর করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
এমনটাই দাবি করছেন দুই বাঙালি চিকিৎসা-বিজ্ঞানী। ক্যানসারের মতো মারণ রোগের চিকিৎসায় ‘ডোপামিন’ নামে ওই রাসায়নিক যৌগ কতটা কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে, সে সম্পর্কে তাঁদের গবেষণাপত্রটি চলতি সপ্তাহে আমেরিকার প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি ফব সায়েন্সেস (পিএনএএস)-এ প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যে কোনও ক্ষত নিরাময়ে ডোপামিনের কার্যকারিতাও সামনে এনেছেন তাঁরা। যে বিষয়ে তাঁদের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে নেচার ইন্ডিয়া পত্রিকায়।
এই গবেষণার সূচনা আদতে কলকাতার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট (সিএনসিআই)-এ। যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী পার্থসারথি দাশগুপ্ত। এবং সেখানেই দীর্ঘ দিন মেডিক্যাল অঙ্কোলজি-র প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন সুজিত বসু। আশির দশকের শেষে তিনি যোগ দেন ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। গত পঁচিশ বছর ধরে ওঁরা ডোপামিন নিয়ে কাজ করে চলেছেন। স্থান বদলালেও ওঁদের কাজের চরিত্র বদলায়নি। এ বার যৌথ ভাবে দু’জনের সেই জোড়া গবেষণাই স্বীকৃতি পেল আন্তর্জাতিক স্তরে।
বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, ডোপামিন মানুষের আচরণগত কিছু দিককে নিয়ন্ত্রণ করে। পারকিনসন্স এবং স্কিজোফ্রেনিয়া রোগের পিছনেও যৌগটির উপস্থিতি গবেষকদের গোচরে ছিল। পরে জানা যায়, ডোপামিন টিউমারের নতুন রক্তনালী তৈরির প্রক্রিয়াকেও নিয়ন্ত্রণ
করে। এই তথ্যটিও দাশগুপ্ত-বসু জুটির বহু বছরের গবেষণার ফলশ্রুতি।
সুজিতবাবু জানিয়েছেন, তাঁদের গবেষণা চলেছে দু’টো ধাপে। প্রথম ধাপে তাঁরা প্রমাণ করেছেন, টিউমারের রক্তনালী সৃষ্টি বন্ধ করতে পারে ডোপামিন। আর দ্বিতীয় ধাপে দেখিয়েছেন, যৌগটি টিউমারের রক্তনালীগুলোর ত্রুটি মেরামত করে কী ভাবে কেমোথেরাপি-রেডিওথেরাপি’র প্রভাবকে মানবশরীরে আরও জোরদার করতে পারে। সুজিতবাবুর কথায়, “টিউমার তৈরি হওয়ার পরে সাধারণত তা দ্রুত বাড়তে থাকে। সে জন্য তার বাড়তি পুষ্টি ও অক্সিজেন দরকার হয়। আর বেঁচে থাকার তাগিদে টিউমারের কোষগুলো তৈরি করে ভাস্কুলার এন্ডোথেলিয়াল গ্রোথ ফ্যাক্টর (ভিইজিএফ), যা কিনা টিউমারে রক্তনালী তৈরি করতে সাহায্য করে। প্রক্রিয়াটিকে বলে অ্যাঞ্জিওজেনেসিস। এই সব রক্তনালী টিউমারকে খাদ্য ও অক্সিজেন জোগায়। তাই ওগুলোকে নষ্ট করতে পারলে টিউমারও নষ্ট করে ফেলা সম্ভব হতে পারে।”
এবং ক্যানসার চিকিৎসায় এটার আলাদা ও বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কেন?
সুজিতবাবুর ব্যাখ্যা: ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে নতুন ভাবে তৈরি রক্তনালীর গঠনগত নানা ত্রুটি থাকে। তাই বহু ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি পুরোপুরি কাজ করে না। ফলে চিকিৎসায় আশাব্যঞ্জক ফল হয় না, কিংবা রোগ কিছু দিন বাদে ফিরে আসে। এখানেই ডোপামিনের ভূমিকা। সুজিতবাবু জানাচ্ছেন, “ডোপামিন বাইরে থেকে ওষুধ হিসেবে শরীরে প্রবেশ করালে রক্তনালীর অস্বাভাবিকতাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কেমো বা রেডিয়েশন ঠিক জায়গায় পৌঁছে ক্যানসারের কোষগুলোকে ধ্বংস করতে পারে। চিকিৎসায় স্থায়ী ফল পাওয়ার আশা থাকে।”
এ হেন যে যৌগ এত কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে, চিকিৎসাশাস্ত্রে তার প্রয়োগ অবশ্য নতুন নয়। পারকিনসন্স ও বিভিন্ন ধরনের ‘শক্’-এর চিকিৎসায় ডোপামিন ব্যবহার করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আরও একটি বিশেষত্বের সুবাদেও ডোপামিন গরুত্বপূর্ণ। তা হল, এর দাম। পার্থসারথিবাবুর কথায়, “রক্তনালীর ত্রুটি দূর করার বাজারচলতি একটা ওষুধ আছে ঠিকই, তবে তা খুবই দামি। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ডোপামিনে একই কাজ হবে অত্যন্ত সস্তায়!” উপরন্তু ডোপামিনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও খুব কম বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা।
পাশাপাশি ক্ষত নিরাময়ের ক্ষেত্রেও ‘ডোপামিন ম্যাজিক’-এর হদিস দিয়েছে বসু-দাশগুপ্তের গবেষণা। সেটা কী রকম?
ওঁদের দাবি: শরীরে যে কোনও ক্ষত থেকে সংক্রমণ ঠেকাতে চিকিৎসকেরা অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে থাকেন। কিন্তু ক্ষত সারিয়ে তুলতে ডোপামিন অনেক দ্রুত কাজ দেয়। যৌগটি এ ক্ষেত্রেও রক্তনালীর বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্ষত শুকিয়ে ফেলতে সাহায্য করে।
আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতিলাভের পরে দুই চিকিৎসা-বিজ্ঞানী এখন তাঁদের বাঙালি তথা ভারতীয় পরিচয়টাকেই সামনে আনতে উৎসাহী। গবেষণার কাজে ছাত্রছাত্রীদের সাহায্যের কথাও বারবার উল্লেখ করেছেন দু’জন। ওঁদের বক্তব্য, “এ দেশের গবেষকেরাও প্রচুর নতুন দিক খুলে দিচ্ছেন। অথচ ঠিকঠাক প্রচারের অভাবে আমজনতার কাছে তা অজ্ঞাত থেকে যাচ্ছে।” |