মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সংসদে বিতর্কের মধ্যেই খাদ্যপণ্যে মূল্যবৃদ্ধির হার সরকারকে কিছুটা স্বস্তি দিল। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে খাদ্যপণ্যে মূল্যবৃদ্ধির হার ৬.৬ শতাংশে নেমেছে, গত ৩৯ মাসে যা সর্বনিম্ন। সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হার নেমেছে ৮ শতাংশে। এই পরিসংখ্যানকে অস্ত্র করেই আজ মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের উপর তৈরি হওয়া চাপ কাটাতে মেজাজে ব্যাট চালালেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। মুখে তিনি বলেছেন, কেন্দ্র এ নিয়ে ঢাক পেটাতে চায় না। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকার কিছুই করেনি বলে বিরোধীরা যে অভিযোগ করেছেন, এই পরিসংখ্যান দেখিয়েই তা খারিজ করে দেন প্রণববাবু।
গত কাল যে ভাবে রাজ্যসভায় সরকারকে বিরোধীদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল, আজ ঠিক একই ভাবে লোকসভায় বিজেপি ও বামেদের আক্রমণের মুখে পড়েছেন প্রণব। সুষমা স্বরাজ তাঁর নিজের বাড়ির মুদিখানার ফর্দ এনে সরকারকে আক্রমণ করে বলেন, “মূল্যবৃদ্ধির জালে আটক আম আদমিকে প্রণববাবু পরিসংখ্যানের জালে বাঁধতে চাইছেন।” পাল্টা জবাবে প্রণব বলেন, এনডিএ-র আমলে মূল্যবৃদ্ধির কী ছবি ছিল, সেই পরিসংখ্যানও তাঁর কাছে রয়েছে। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে সুষমা বলেন, “আপনারা না পারলে গদি ছাড়ুন। আমরা এসে সমাধানের পথ বাতলাব।” সুষমার মতো বাসুদেব আচারিয়া-গুরুদাস দাশগুপ্তরাও সরকারকে আক্রমণ করে অভিযোগ তোলেন, সংসদে দু’বার প্রস্তাব পাশ হওয়া সত্ত্বেও সরকার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে।
এই বিতর্কের মধ্যেই আজ বেশ কয়েক বার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতির লড়াই উঠে এসেছে সংসদে। বাম নেতারা অভিযোগ তুলেছেন, এত দিন পশ্চিমবঙ্গে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। এখন তা-ও ঘটছে। পাল্টা আক্রমণে গিয়েছেন তৃণমূল ও কংগ্রেস সাংসদরা। তবে রাজ্যসভায় প্রণববাবু আজ ফের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, মূল্যবৃদ্ধির পিছনে আন্তর্জাতিক সঙ্কট যেমন দায়ী, তেমনই পরিকাঠামোর অভাবও রয়েছে দেশের সরবরাহ ব্যবস্থায়। এ ক্ষেত্রে যে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি অনেকটাই সাহায্য করতে পারত, আজ ফের সেই যুক্তি দিয়েছেন প্রণব। রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলির ২০০৪ সালের বক্তব্য উদ্ধৃত করে প্রণব জানান, সে সময় জেটলি কিন্তু খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির পক্ষে সওয়াল করেছিলেন।
আজ বিরোধীরা সরকারের সমালোচনা করে বলেন, এক দিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়াচ্ছে। তা করতে গিয়ে আবার শিল্প ও আবাসন ক্ষেত্রে বৃদ্ধি শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। ফলে ভুল নীতি নিয়ে সরকারই নিজে দেশের অর্থনীতিকে মন্দার মুখে ঠেলে দিচ্ছে। প্রণববাবুর পাল্টা যুক্তি, ২০০৮ সালের মন্দার মোকাবিলায় যে ‘স্টিমুলাস প্যাকেজ’ দেওয়া হয়েছিল, তার ফলে বাজারে নগদ জোগানের পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। অতিরিক্ত নগদ জোগান শুষে নিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদের হার বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার কোনও আশু প্রভাব দেখা না যাওয়ার কারণ, ফের আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সঙ্কটের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ইউরোপে সঙ্কটের ফলে বিদেশি লগ্নি কমেছে। দেশের রফতানিও ধাক্কা খেয়েছে।
প্রণববাবুর যুক্তি, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম লাগাতার ব্যারেল প্রতি ১১০ ডলারের উপরে থাকা মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ভর্তুকিতে জ্বালানি তেল বেচতে গিয়ে এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলির ক্ষতি হচ্ছে। সরকারের পক্ষে পেট্রো-পণ্যের উপরে করের বোঝা কমানোও সম্ভব নয়। তা হলে আবার বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হবে। কেন্দ্র যে হেতু সেই রাজস্ব রাজ্যের সঙ্গে ভাগ করে নেয়, তাই রাজ্যগুলিও সমস্যায় পড়বে। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে তাই আজ ফের সব পক্ষের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রণববাবু। |