ওয়ালমার্ট বা টেসকো-র নাম ওঁদের জানার কথা নয়। তবে বড় সংস্থাকে ফসল বিক্রি নিয়ে চারদিকের শোরগোলের আঁচ ওঁদের কানেও পৌঁছেছে। যা শুনে ওঁরা বলছেন, “ফড়ের হাতে এমনিতেই তো মার খাচ্ছি। বড় কোম্পানিকে সরাসরি খেতের ফসল বেচলে লাভের মুখ দেখব কি না, সেটা কোম্পানির লোকই এসে বলুক না!”
ওঁরা সিঙ্গুরের চাষি। সেই সিঙ্গুর, কৃষকের জমিরক্ষার আন্দোলনের সুবাদে যা শিরোনামে উঠে এসেছিল। সেখানকার কাশীনাথ দাস-দিলীপ দাসের মতো কৃষকেরা জানেন না, ওই সব বড় কোম্পানিকে সরাসরি খেতের সব্জি বিক্রি করলে লোকসানের হিসেব লাভে বদলে যায় কি না। কিন্তু ফড়ে-রাজের দাপটে এখনও লাভ-লোকসানের হিসাব মেলাতে পারছেন না তাঁরা।
সিঙ্গুরের বেড়াবেড়িতে টাটাদের পরিত্যক্ত কারখানার পাঁচিলের গা ঘেঁষে কাশীনাথবাবুর জমি। টাটাদের প্রকল্প-এলাকার মধ্যে জমি না-পড়ায় সে সময়ে নিজের অদৃষ্টকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। সে যাত্রা খুশি হয়েছিলেন এই ভেবে যে, বাপ-ঠাকুর্দার জমিতে নিজের হাতে ফসল ফলাতে পারবেন। সেই খেত এখন ভরে রয়েছে ফসলে।
তবু সুখ নেই কাশীনাথবাবুর। বৃহস্পতিবার নিজের চষা খেতের ধারে বসে বছর ষাটের বৃদ্ধ হতাশ, তিক্ত স্বরে বললেন, “এখন গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।” |
কেন? কাশীনাথবাবু জানালেন, “ন’কাঠা জমিতে লাউ ফলিয়েছিলাম। মোট খরচ হয়েছিল ১১ হাজার টাকা। ফড়েরা যে দাম দিচ্ছে, তাতে সব লাউ বেচে পাব ৩৬০০ টাকা। এক চাষেই ৭৪০০ টাকা লোকসান! কী করে দিন চলবে, বুঝতে পারছি না।”
গত বার লাউ বেচে কোনও মতে সংসার চালিয়েছিলেন কাশীনাথবাবু। কিন্তু এ বার যে এমন হাল হবে, স্বপ্নেও ভাবেননি। বৃদ্ধ বলেন, “লাউ চাষে খরচ অনেক। ঝামেলাও বিস্তর। বাঁশের মাচা বানিয়ে তাতে দড়ি বেঁধে লাউ ফলাতে হয়। রোদ-হাওয়া খেলার জন্য লাউয়ের পাতা কেটে দিতে হয়। পনেরো দিন অন্তর একটা করে, মোট তিনটে সেচ দিয়ে জমিতে জল ধরাতে হয়। তিন মাসের মাথায় ফসল পাওয়া যায়।”
আর এত ঝক্কি পুইয়ে তাঁর খেতে প্রায় ১৮০০ লাউ হয়েছে। কিন্তু ফড়েরা লাউপিছু দাম ধরেছে মাত্র ২ টাকা! কাশীনাথবাবুর আক্ষেপ, “আমাদের থেকে দু’টাকায় কিনে শেওড়াফুলি বা কলকাতার বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৮ টাকায়। আমরা কিছুই পাচ্ছি না। লাভের গুড় খেয়ে যাচ্ছে ফড়েরা।”
তা হলে বড় কোম্পানির কাছে সরাসরি ফসল বেচছেন না কেন? এ নিয়ে তো চার দিকে এত আলোচনা!
ওঁরা এ ব্যাপারে ‘পরের মুখে ঝাল’ খেতে রাজি নন। লাভ-লোকসানের হিসেব তাঁরা নিজেরা যাচাই করতে চান। বেড়াবেড়ি পূর্বপাড়ার হরিপদ দাসের কথায়, “সবই শুনছি। কাগজে পড়ছিও। কিন্তু বড় কোম্পানিকে সব্জি বেচলে কী লাভ, সেটা আমরা ওই সব কোম্পানির লোকের কাছ থেকেই জানতে চাই।”
যত দিন সেটা জানা না-যায়, তত দিন কাশীনাথবাবুর মতোই হাবুডুবু খাচ্ছেন বাজেমেলিয়ার দিলীপ দাস। নিজের পাঁচ কাঠা জমি জুড়ে ঢ্যাঁড়শ চাষ করেছিলেন। দিলীপবাবু এখন বলছেন, “প্রতি কাঠায় পাঁচশো টাকা খরচ। কাঠাপিছু ২২৫ কেজির মতো ঢ্যাঁড়শ ফলে। সব মিলিয়ে পাঁচ কাঠায় আড়াই হাজার টাকা ঢেলে হাজার কেজি ফসল পেয়েছি।”
দাম কী পেলেন? দিলীপবাবু বলেন, “সব মিলিয়ে আড়াই হাজার টাকা।”
অর্থাৎ বীজ, সার ইত্যাদির খরচই শুধু উঠেছে। তাঁর তিন মাসের মজুরি আর লাভ কোথায় গেল, তার হিসেব খুঁজে পাচ্ছেন না দিলীপবাবুও।
হিসেব মেলানো যায় কি না, বড় কোম্পানির লোকের মুখ থেকেই তা যাচাই করতে চাইছে কৃষিজীবীদের সিঙ্গুর। |