কাজে নামার আগে নিজেদের দলটাকেই কেন প্রস্তুত করা হয়নি, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে এখন সেই প্রশ্ন সামলাতে হচ্ছে মনমোহন সিংহের সরকারকে। যে কারণে এই বিষয়ে পিছু হঠার কথা ঘোষণা করার ২৪ ঘণ্টা না কাটতেই, অর্থমন্ত্রী আজ জানিয়ে দিয়েছেন, বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্তে কোনও ভুল হয়নি। তবু সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে হয়েছে অসময়ে নির্বাচন এড়ানোর জন্যই। সরকার পড়ে যাওয়ার অস্বস্তিকর আশঙ্কার কথা এ ভাবে স্বীকার করে নিয়েও প্রণব মুখোপাধ্যায় এ দিন বোঝাতে চেয়েছেন, খুচরো ব্যবসার বিদেশি লগ্নির বিষয়টি এখানেই থমকে যাচ্ছে না। বরং সরকার বিষয়টি নিয়ে এগোবেই। সব দলের সম্মতি পাওয়ার চেষ্টাও চালিয়ে যাবে সরকার। সন্দেহ নেই এ ক্ষেত্রে নিজেদের দলেই যে প্রশ্নগুলি উঠছে সবার আগে তার উত্তরই দিতে হচ্ছে মনমোহন সিংহ, প্রণববাবুদের।
কারণ সিদ্ধান্তকে ‘ঠিক’ বলেই প্রণববাবু বা সরকারের শীর্ষ নেতারা দলের মধ্যে পার পাচ্ছেন না। বরং কংগ্রেস নেতা সাংসদদের মধ্যে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সরকারের যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই এবং তৃণমূল কংগ্রেস যে এ ব্যাপারে বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারে তা কেন আগাম আঁচ করতে পারেননি শীর্ষ নেতারা? কেনই বা দলকে বুঝিয়ে ও কাজে লাগিয়ে বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির জন্য জনমত গড়তে আগাম জমি তৈরি করা হয়নি?
এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি জানান, “সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রণববাবু আজ খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ব্যাখ্যা দেন। শীঘ্রই তিনি কংগ্রেস সাংসদদের সঙ্গে ফের বৈঠক করবেন ও তাঁদের প্রশ্নের জবাব দেবেন।
আজকের বৈঠকে প্রণববাবু বলেন, “খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত সময়ের দাবি। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে ভুল ছিল না। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে যখন সংসদে মুলতুবি প্রস্তাব এনে ভোটাভুটির প্রশ্ন ওঠে, তখন সরকারের এক শরিক দলই বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার অবস্থান নেয়। স্বাধীনতার পর এই প্রথম শাসক জোটের মধ্যে থেকেই একাংশ সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিত। সে ক্ষেত্রে সরকার সংসদে ভোটাভুটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারত না এবং হেরে যেত। যদিও তাতে সরকারের পতন ঘটত না, কিন্তু নৈতিক চাপ তৈরি হত কেন্দ্রের ওপর। তার পর লোকসভার মধ্যবর্তী নির্বাচন ছাড়া আর কোনও পথ থাকত না। সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে যেতে চায়নি বলেই সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে।”
একই সঙ্গে প্রণববাবু এ-ও জানিয়ে দেন, “কংগ্রেসের যে সাংসদরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের সমর্থনে গত কয়েক দিন ধরে সওয়াল করেছেন, তাঁদের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। কেন-না স্থগিত রাখার অর্থ, সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া নয়। এ ব্যাপারে সব পক্ষের সঙ্গে দ্রুত আলোচনা করে সর্বসম্মতি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবে সরকার।” সরকারের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, সর্বসম্মতির জন্য আলোচনা করতে গত কালই প্রণবকে দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তবে তার আগে প্রণববাবু বা কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা তথা মনমোহন সরকারকে যে কংগ্রেস সাংসদদের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কেরলের কংগ্রেস সাংসদ এম কে রাঘবন আজ বলেন, “ভারতীয় রাজনীতিতে রক্ষণশীলতা রয়েছে তা নতুন করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির মতো বিষয় তো সব সময়েই স্পর্শকাতর। এটা মাথায় রেখে সরকারের উচিত ছিল আগে থেকে দলকে বোঝানো। তার পর কংগ্রেস তা নিয়ে গোটা দেশে প্রচার করে কৃষক ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে জনমত গড়তে পারত। সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বোঝানোর চেষ্টা করত যে, তাঁদের স্বার্থে আঘাত পড়বে না। অর্থাৎ আজ সরকার ও কংগ্রেস যেটা করছে, সেটা আগাম করলেই কোনও অসুবিধা হত না। কারণ সেই বিতর্কে যোগ দিয়ে শিল্প মহল, কৃষক সমাজ ও সাধারণ মানুষও সমর্থন জোগাত। তা পরোক্ষে চাপ তৈরি করত বিরোধী দলের উপরে।”
প্রণববাবুর নিজের রাজ্য তথা পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা ও সাংসদ অধীর চৌধুরীও আজ বলেন, “খুচরো বিতর্কে প্রথমে হই-হই করে এগিয়ে তার পর যে ভাবে সরকারকে পিছু হটতে হয়েছে তাতে মুখ পুড়েছে সংশয় নেই। সংসদ চলাকালীন কেন যে এই নীতি কেন্দ্র ঘোষণা করতে গেল সেটাই বোধগম্য নয়।” সংবাদমাধ্যম যে-ভাবে কেন্দ্রের এই নীতিকে সমর্থন জানাচ্ছে, তাতে সংসদের অধিবেশনের আগে বা পরে এই পদক্ষেপ করলে কোনও অসুবিধা হত না বলেই মনে করছেন অধীরবাবু। তাঁর কথায়, “সরকার এই সুবর্ণ সুযোগ হারাল। সরকারের দুর্বলতা যেমন প্রকট হল, তেমনই বিদেশি লগ্নির সম্ভাবনাও বিলম্বিত হল। অথচ খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি যে আশু প্রয়োজন তা নিয়ে সংশয় নেই।” নিজের জেলার উদাহরণ দিয়ে অধীরবাবু বলেন, “সেখানে চাষীরা আট আনায় কপি বিক্রি করছেন, আর দিল্লিতে সেই কপিই বিক্রি হচ্ছে কুড়ি টাকায়। বিদেশি লগ্নি এলে কিন্তু চাষীরা বেশি দাম পেতেন।”
উত্তরপ্রদেশ ভোটে হাত পোড়ার আশঙ্কায় এর আগেই প্রকাশ্যে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত বিরোধিতা করেছিলেন দুই কংগ্রেস বিধায়ক প্রবীণ অ্যারন ও সঞ্জয় সিংহ। আবার রাজস্থানের কংগ্রেস সাংসদ জ্যোতি মির্ধার বক্তব্য, “কেন্দ্রের খুচরো নীতিতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। অন্তত ৩০ শতাংশ পণ্য দেশের ছোট ও মাঝারি শিল্প সংস্থাগুলির থেকে কেনাটা বাধ্যতামূলক বলা হলেও তা অনেকটাই লোক দেখানো বলে প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। কারণ, এ ব্যাপারে নজরদারি রাখা কঠিন কাজ।”
কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি এবং গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশ সরকারের নীতি নিয়ে সমালোচনা করে ইতিমধ্যেই সনিয়া গাঁধীর হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। জয়রাম এ ব্যাপারে সনিয়াকে চার পাতার একটি চিঠিও লিখেছেন। এই পরিস্থিতিতে খুচরো-ব্যসায় বিদেশি লগ্নির বিতর্কে সর্বসম্মতি গড়ে তোলার আগেই নিজেদের দলকে পাশে নিতে হবে মনমোহন-প্রণবকে। এ যাত্রায় যা বিড়ম্বনা হওয়ার হয়ে গেল, ভবিষ্যতে যাতে তার পুনরাবৃত্তি না হয় তা সুনিশ্চিত করাটাই এখন লক্ষ্য সরকারের। |