কোথাও সামান্য প্লাগ পয়েন্ট বসানো দরকার ছিল, কোথাও বা একটু জায়গা। ছ’মাসে এই পরিকাঠামোও দেওয়া গেল না সরকারি হাসপাতালে। ফলে অসুস্থ নবজাতকের চিকিৎসায় অতি প্রয়োজনীয় রেডিয়্যান্ট ওয়ার্মার যন্ত্র পড়ে থাকল হাসপাতালের গুদামেই।
মালদহ জেলা হাসপাতালে সম্প্রতি ৯ দিনে পরপর ২০টি শিশুমৃত্যুর ঘটনার তদন্তে গিয়ে বিষয়টি স্বাস্থ্য-কর্তাদের নজরে পড়ে। তাঁরা জানতে পারেন, নবজাতকেরা অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে রেডিয়্যান্ট ওয়ার্মার যন্ত্র ব্যবহার হয়নি। কেন? খোঁজ করে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, হাসপাতালে ৮টি রেডিয়্যান্ট ওয়ার্মার কেনা হয়েছিল। কিন্তু প্লাগ পয়েন্ট নেই বলে ছ’মাস ধরে সেগুলি রয়ে গিয়েছে গুদামেই। এর পরে যে যে হাসপাতালে ওই যন্ত্র দেওয়া হয়েছিল, সেখানে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে স্বাস্থ্য দফতর। তখনই গোটা বিষয়টা ধরা পড়ে।
কী এই রেডিয়্যান্ট ওয়ার্মার? শিশু চিকিৎসকেরা বলছেন, অসুস্থ নবজাতকদের চিকিৎসার অন্যতম জরুরি প্রক্রিয়া হল বাইরে থেকে তাপ দিয়ে দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখা। আগে বাল্ব জ্বালিয়ে গরম রাখা হত শিশুদের। তাতে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে বলে আসে রেডিয়্যান্ট ওয়ার্মার। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, নবজাতকের মৃত্যু কমাতে মাস ছ’য়েক আগে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ১ হাজার ৪৮০টি ওয়ার্মার কিনেছিল। তার মধ্যে ১ হাজার ৪৫০টি সরবরাহ করা হয় বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে। তার মধ্যে সাকুল্যে ২০০টি চালু করা গিয়েছে। বাকি ১ হাজার ২০০ রেডিয়্যান্ট ওয়ার্মার পড়ে রয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালের গুদামে!
হাসপাতাল-কর্তারা অবশ্য যন্ত্র কার্যকর না হওয়ার দায়টা চাপিয়ে দিয়েছেন যন্ত্র সরবরাহকারী সংস্থার উপরে। এক হাসপাতাল-কর্তার মন্তব্য, চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহকারী সংস্থারই যন্ত্র বসিয়ে চালু করে দেয়। তারা কিছুই করেনি। যন্ত্র সরবরাহকারী সংস্থা আবার দুষছে পরিচালন ব্যবস্থাকে। সরবরাহকারী সংস্থার মুখপাত্র এ সুজল বলেন, “স্বাস্থ্যকর্তাদের পরিকল্পনা নেই, উৎসাহ নেই, দায়বদ্ধতা নেই। অর্ধেক হাসপাতালের প্রধান বা জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের যোগাযোগের নম্বর জানানো হয়নি। ফলে যন্ত্র পাঠাতে দেরি হচ্ছে। যন্ত্র বসাতে লোক গেলে কেউ বলছে জায়গা নেই। কেউ বলছে প্লাগ পয়েন্ট নেই, কেউ বলছে যন্ত্র চালানোর লোক নেই।” অথচ মালদহ হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর পরেই কিন্তু বসে গিয়েছে ৬টি যন্ত্র। কী ভাবে সেটা সম্ভব হল? এই তৎপরতা আগে দেখানো হয়নি কেন? রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ আধিকারিক জ্যোতির্ময় চাকীর উত্তর, “সেটা আমাদের দফতরের ভিতরের ব্যাপার। বাইরের লোককে বলব না।”
রেডিয়্যান্ট ওয়ার্মার যন্ত্র কেনা এবং বসানোর দায়িত্ব রয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের অধীন হেলথ কর্পোরেশনের হাতে। কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুনীত যাদব বলেছেন, “পরিকল্পনায় বড় একটা গোলমাল হয়েছে। আগে যাঁরা কর্পোরেশনের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা রেডিয়্যান্ট ওয়ার্মারের ব্যাপারে মন দেননি। প্লাগ পয়েন্ট বসাতে, জায়গা দিতে ঢিলেমি হয়েছে। পুরো পরিকল্পনা মাঠে মারা গিয়েছে।” সপ্তাহখানেক আগেও বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে পরপর শিশুমৃত্যুর পর সরবরাহকারীরা গুদাম থেকে রেডিয়্যান্ট ওয়ার্মার যন্ত্র বার করে চালু করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়ে দেন, যন্ত্র বসানোর জায়গা ঠিক হয়নি। যন্ত্রগুলোর সদ্ব্যবহার কী ভাবে হবে? যন্ত্র বসাতে ঢিলেমির জন্য শাস্তি কার প্রাপ্য? স্বাস্থ্য দফতর, হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ, সরবরাহকারী সংস্থা প্রত্যেকেই একে অপরকে দুষতে ব্যস্ত। স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, “এ তো প্রক্রিয়াগত ত্রুটি। কাকে কী বলব?” ফলে বাকি ১২০০ যন্ত্র কবে গুদাম থেকে বেরোবে, জানা নেই কারও। |