কেন্দ্রীয় আইন মেনে রাজ্যের নতুন সরকারও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল রদ করেছে। তার পরেও ওই স্তর পর্যন্ত পাশ-ফেল না-রাখার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য কেন্দ্রকে অনুরোধ করল তারা।
শিক্ষার অধিকার সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় আইনে বলা বয়েছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পড়ুয়াকেই ফেল করানো যাবে না। ওই আইন মেনে ২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গেও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা রদ করছে রাজ্য সরকার। সম্প্রতি রাজ্য মন্ত্রিসভা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগীদের অনেকেই মনে করেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তে আখেরে সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে
পড়ুয়াদেরই। দুর্বল, অতি দুর্বল পড়ুয়ারাও বিনা বাধায় উপরের ক্লাসে চলে গেলে সামগ্রিক ভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্কুলশিক্ষার পাশাপাশি বিরূপ প্রভাব পড়বে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও।
প্রকৃতপক্ষে রাজ্য সরকারও যে এমনটাই আশঙ্কা করছে, মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী কপিল সিব্বলকে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর লেখা চিঠির বয়ানেই তা স্পষ্ট। মঙ্গলবার সিব্বলকে পাঠানো ওই চিঠিতে ব্রাত্যবাবু বলেছেন, ‘যারা দুর্বল, পড়াশোনার উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি, নির্বিচারে তাদেরও উপরের ক্লাসে তুলে দিলে শিক্ষক-ছাত্র উভয়ের পক্ষেই গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে।’ এতে মানের সঙ্গে আপসের আশঙ্কা রয়েছে বলেও শিক্ষামন্ত্রীর আশঙ্কা। চিঠিতে এ কথা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্রাত্যবাবু বিভিন্ন মহলেও বলেছেন, ব্যক্তিগত ভাবে তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার বিরোধী।
মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীকে চিঠিতে ব্রাত্যবাবু লিখেছেন, স্কুলশিক্ষার মানোন্নয়নে রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই উদ্যোগী হয়েছে। পাঠ্যক্রম কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী স্কুলের পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজার বন্দোবস্ত হচ্ছে। পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে কী ধরনের উন্নয়ন প্রয়োজন, তা জানতে আইআইএম-কলকাতাকে দিয়ে একটি সমীক্ষাও করানো হয়েছে।
পাশ-ফেল নিয়ে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ জানিয়েছিল অধিকাংশ শিক্ষক সংগঠন। শিক্ষানুরাগীদের অনেকেও সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। এমনকী সরকারের গড়া পাঠ্যক্রম কমিটির চেয়ারম্যান সুনন্দ সান্যাল এই ব্যাপারে ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ দেন। শুধু তা-ই নয়, বুধবার শিক্ষামন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্রও পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। ব্রাত্যবাবু অবশ্য বলেছেন, ২০১৩ সালের মধ্যে পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজার যে-উদ্যোগ চলছে, তা ভাল ভাবে বাস্তবায়িত করতে হলে সুনন্দবাবুর মতামত খুবই জরুরি। তাই তাঁকে ইস্তফার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে অনুরোধ জানানো হবে।
কিন্তু রাজ্য সরকারেরও যদি আশঙ্কা থাকে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল ব্যবস্থা রদ করে দিলে শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি হতে পারে, তা হলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কেন?
স্কুলশিক্ষা দফতরের এক কর্তার মতে, শিক্ষার অধিকার আইন যে-হেতু সংসদে পাশ হয়েছে, তাই রাজ্যের পক্ষে সেটিকে উপেক্ষা করা কঠিন। তা ছাড়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা যখন এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন রেলমন্ত্রী ছিলেন। ফলে তাঁর নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের পক্ষে এখন কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে গররাজি হওয়াটা অস্বস্তিকর।
এক প্রবীণ শিক্ষকের মতে, কেন্দ্রকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করানোর জন্য যে-ভাবে জনমত গড়ে তোলা দরকার ছিল, রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি তা করেনি। তারা অন্য অনেক বিষয়ে সক্রিয় হতে বা জোরদার রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতে যতটা তৎপর হয়, শিক্ষার ব্যাপারে ততটা নয়!
এখন শিক্ষার অধিকার আইনটি বলবৎ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরে শিক্ষানুরাগীদের অনেকেই বিশেষত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছেন। সম্ভবত সেই কারণেই ২০১৩ সালে ওই আইন রূপায়ণের জন্য ব্যবস্থা নিতে শুরু করেও রাজ্য সরকার এই একটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আবেদন জানাল কেন্দ্রের কাছে। |