ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের থেকে ১০ কুইন্টাল পর্যন্ত ধান কেনার ক্ষেত্রে চেকের বদলে নগদে টাকা দিতে চাইছে রাজ্য সরকার। রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জানিয়েছেন, “মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই আমাদের এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন। কিন্তু সরকারি ধান কেনার ক্ষেত্রে চেক দেওয়ার নিয়ম চালু করেছে কেন্দ্র। তা শিথিল করার জন্য রাজ্যের মুখ্যসচিব কেন্দ্রের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছেন।” পাশাপাশি, ১৫ ডিসেম্বর থেকে পুরোদমে ধান কেনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
গত মরসুমের বোরো ধান চাষির ঘরে এখনও অনেকটাই জমে রয়েছে। বহু এলাকায় অভাবী বিক্রি চলছে। তার উপরে নতুন আমন ধান উঠতে শুরু করায় চাষিরা প্রমাদ গুনছেন। সম্প্রতি বর্ধমানে দুই চাষির আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবারের তরফে ধান বিক্রি না হওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে। যদিও প্রশাসন বা খাদ্য দফতর তা মানতে চায়নি। তবে মজুত ধান বিক্রি করতে না পেরে চাষিরা যে সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন, খাদ্যমন্ত্রী তা অস্বীকার করেননি। তাঁর কথায়, “চাষিদের বলছি একটু ধৈর্য ধরতে। ইতিমধ্যেই ধান কেনা শুরু হয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর থেকে তা পুরোদমে শুরু হবে।”
বোরো মরসুমে যে বিপুল উৎপাদন হয়েছিল, তা কিন্তু নয়। তা সত্ত্বেও যে চাষির ঘরে চাল জমে গিয়েছে তার জন্য চাষিদের একাংশের মানসিকতা এবং ভিন্ রাজ্য থেকে আসা চালকে দায়ী করছে কৃষি ও কৃষি বিপণন দফতর। কেননা, চাষিদের আগে থেকেই বোরো ধান বেশি চাষ করতে নিষেধ করেছিল কৃষি দফতর। কিন্তু অনেকেই তাতে কর্ণপাত করেননি। পরে ধান বিক্রি করার ক্ষেত্রেও অনেকে গোঁ ধরে থেকেছেন।
অন্যতম ধান উৎপাদক জেলা হুগলির সহকারী কৃষি অধিকর্তা সতীনাথ পালিতের মতে, “ভাল দাম পাওয়ার আশায় প্রথমে বহু চাষিই ধান ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, বিহারের চাল ঢুকে যাওয়ায় ততটা দাম ওঠেনি, ধানও আর বিক্রি হয়নি। ফলে, অন্য জেলার মতো হুগলিতেও অভাবী বিক্রি হচ্ছে।” বর্ধমানের কৃষি বিপণন দফতরের সহ-অধিকর্তা প্রিয়দর্শী সেনের মতে, “এই জেলা তো বটেই, রাজ্যের বাজারে যে পরিমাণ চাল সরবরাহ হয় তার ২০ থেকে ২২ শতাংশ অন্ধ্রের চাল। বাইরের রাজ্য থেকে আসা ওই সব চাল দেখতে ভাল। মানুষ ওই চালের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। দেশি চালের বাজার পড়ছে।”
অগস্টের শেষে রাজ্য সরকার সহায়ক মূল্যে ধান কিনতে নামায় কিছুটা আশার আলো দেখেছিলেন চাষিরা। কিন্তু সমস্যার নিরসন হয়নি। কারণ, প্রথমত অন্য বারের মতো বেনফেড, কনফেড, ইসিএসসি-র মতো রাজ্য সরকারি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়ার বদলে চালকল মারফত ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তেমন চালকলের সংখ্যা বেশি নয়। যেমন বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট ব্লকে মাত্র একটি, মন্তেশ্বর ব্লকে দু’টি, ভাতার ব্লকে মাত্র চারটি এ রকম চালকল রয়েছে। মুর্শিদাবাদে মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক হয় যেখানে, সেই কান্দি মহকুমায় ১৫টি চালকল আছে। বাকি চারটি মহকুমা মিলিয়ে আছে সাতটি। একই পরিস্থিতি বীরভূমেও। সেখানকার খয়রাশোল ব্লকের কমলপুরের চাষি দিলীপ দাস, দুবরাজপুর ব্লকের গুণসীমা গ্রামের খিলাফত হোসেন, ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকের আবুল আহাদ শেখদের খেদ, “আমাদের অনেকেরই গরুর গাড়ি নেই। ভাড়া করে ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে ধান নিয়ে যেতে খরচ পড়ছে কুইন্টাল প্রতি ৩০-৪০ টাকা। সেই সঙ্গে দু’জন মজুরের বেতন বাবদ আরও ২০০ টাকা। তার উপরে চালকলে ভিজে ধান বা ধুলোবালি বাবদ কুইন্টালে ১০-১৩ কিলো বাদ দেওয়া হচ্ছে। খরচে পোষাচ্ছে না।” বুধবার হুগলির আরামবাগে চালকল মালিকদের উদ্দেশে খাদ্যমন্ত্রীও বলেন, “ধুলোবালির অজুহাত দিয়ে ধানের ওজন বাদ দেওয়ার প্রচুর অভিযোগ পাচ্ছি। এটা করবেন না। আপনাদের পাওনা সরকারের থেকে বুঝে নিন।”
সঙ্কটের দ্বিতীয় কারণ, দালাল বা ফড়েদের আটকাতে চেকে চাষিদের টাকা দেওয়া শুরু হয়েছে। যাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, তাঁদের ‘জিরো ব্যালান্স অ্যাকাউন্ট’ খোলার জন্য ব্যাঙ্কগুলিকে সরকারি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরেও সমস্যা যাচ্ছে না। ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক চাষি যাঁরা ধান বিক্রি করে দু’-পাঁচ হাজার টাকা পাবেন, তাঁরা এত হ্যাপা পোহাতে আগ্রহী হচ্ছেন না। মঙ্গলবার দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে এ নিয়ে চাষিরা ধন্দে পড়েন। ধান বিক্রি করতে না পেরে তপন ব্লকের বটতলায় পথ অবরোধও করেন শতাধিক চাষি। তৃতীয়ত, বোরো মরসুমের পুরনো ধান কিনতে চালকলগুলি বিশেষ উৎসাহী নয়। কেননা, পুরনো ধান থেকে কম চাল পাওয়া যায়। তাতে লোকসান হয়। চতুর্থত, চালকলকে টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দীর্ঘসূত্রিতা। বীরভূমের চালকল মালিকদের অভিযোগ, এ দিনই সবে তাঁরা গত বছরের লেভির চালের দাম পেয়েছেন। আগে চাষি ও চালকলের মধ্যে থাকা আড়তদারেরা যেমন মুনাফা করতেন, তাঁদের পুঁজিও চাল কেনাবেচায় ঢুকত। বীরভূম জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি দীপক প্রামাণিকের বক্তব্য, “কয়েক হাজার আড়তদার চাষিদের কাছ থেকে ধান কিনে কলে দিতেন। তাঁদের টাকা তৎক্ষণাৎ মেটাতে হত না। কিন্তু চাষিদের তৎক্ষণাৎ চেক দিতে হচ্ছে। ফলে টাকার টানাটানি হচ্ছে।”
সব মিলিয়ে সরকারকে ধান বিক্রির রাস্তা প্রায় বন্ধ। এক বস্তা (৬০ কিলো) ধান উৎপাদনে যেখানে ৪০০-৪৫০ টাকা খরচ পড়ে, সেখানে খোলা বাজারে প্রায় সেই দামেই ধান কিনতে চাইছেন আড়তদারেরা। সরকারি সহায়ক মূল্য সরু ধানের জন্য কিলোয় ১১.১০ টাকা, মোটা ধানের জন্য ১০.৮০ টাকা। অর্থাৎ বস্তায় যথাক্রমে ৬৬৬ টাকা ও ৬৪৮ টাকা। কিন্তু বেশির ভাগ চাষিই সেই সুবিধা নিতে পারছেন না। অনেকে আবার বিষয়টা পরিষ্কার করে জানেনও না। এ নিয়ে বিপুল প্রচার চালানো হয়েছে বলে রাজ্য প্রশাসন দাবি করলেও মঙ্গলকোটের চাষি স্বপন দত্ত, ভাতারের চাষি ইব্রাহিম মোল্লাদের কথায়, “প্রচার যা হয়েছে, তা মূল সড়ক ধরে। কিন্তু বড় রাস্তার চেয়ে দশ, বারো, কুড়ি কিলোমিটার দূরে গ্রাম রয়েছে যেখানে চাষিরা ধান নিয়ে বসে রয়েছেন।”
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, “যাঁরা অল্প ধান দেবেন তাঁদের যাতে সামান্য টাকার জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে না হয়, তার জন্য ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ১০ কুইন্ট্যাল পর্যন্ত এই ছাড় দেওয়ার আবেদন জানিয়েছি আমরা।” তবে চাষিদের পরিবহণ খরচ নিয়ে এ দিনও কোনও আশার কথা শোনাতে পারেননি তিনি। তাঁর বক্তব্য, “অনেক গ্রামের কাছেই যে চালকল নেই তা আমরা জানি। সে ক্ষেত্রে কী করণীয় তা জানতে চাষিরা এলাকার ব্লক অফিসে যেতে পারেন। তাঁদের সহযোগিতা করার জন্য বিডিও-দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” তবে এক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে বলেও তাঁর আশ্বাস। মন্ত্রীর কথায়, “প্রতি বছরই রাজ্য সরকার ১৫ ডিসেম্বর থেকে সহায়ক মূল্যে ধান কেনে। আমরাও প্রস্তুতি নিচ্ছি। চালকল তো বটেই, গ্রামে-গ্রামে পাঁচ-দশ কিলোমিটার অন্তর শিবির করে ধান কেনা হবে। সমস্যা থাকবে না।”
সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া চাষিদের অতএব গতি নেই। |