মাথায় পাহাড়প্রমাণ ঋণ। তবু চলতি অর্থবর্ষে মাসুল সংশোধনের জন্য রাজ্য সরকারের সম্মতিলাভের কোনও সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানির কর্তারা।
সংস্থা-সূত্রের খবর: মাসুলবৃদ্ধি নিয়ে বিদ্যুৎ দফতর কোনও আলোচনা তো করছেই না, উল্টে কোম্পানিকে লোকসান কমাতে বিদ্যুৎ চুরি রোধে জোর দিতে বলা হচ্ছে। রাজ্য সরকার মৌখিক ভাবে জানিয়েছে, আগামী মার্চে বণ্টন সংস্থার ‘সার্বিক পরিস্থিতি’ পর্যালোচনা করেই তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
আর এতেই প্রমাদ গুনছেন বণ্টন-কর্তারা। কারণ, তত দিনে চলতি অর্থবর্ষের (২০১১-১২) মেয়াদ ফুরিয়ে আসবে। সে ক্ষেত্রে এ বছরের মতো মাসুল সংশোধনের সুযোগ তাঁদের হাতছাড়া হওয়ার প্রভূত আশঙ্কা। তাতে সংস্থার লোকসানের বহর ঠেকতে পারে ২২০০ কোটি টাকায়!
বাজার থেকে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকদের বিক্রি করে বণ্টন সংস্থার এখন আর্থিক ক্ষতি হয় সাড়ে ২৭ শতাংশের কিছু বেশি। রাজ্য সম্প্রতি তাদের জানিয়ে দিয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে এটা ২৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। সরকারের যুক্তি, লোকসান ১% কমানো মানে বছরে ৬৮ কোটি টাকা সাশ্রয়। সেই হিসেবে ক্ষতির হার ২৪ শতাংশে নামাতে পারলে বছরে অন্তত দু’শো কোটির সাশ্রয় হবে বলে রাজ্যের দাবি। |
পাওনা বিল
* অঙ্ক কোটি টাকায় |
বিভিন্ন পুরসভা |
১৫০ |
জনস্বাস্থ্য করিগরি |
৭৩ |
সেচ দফতর |
৪৫ |
পুলিশ |
৩১ |
স্বাস্থ্য দফতর |
১১ |
|
এবং এই লক্ষ্যে বণ্টন সংস্থাকে রাজ্যের আপাতত একমাত্র দাওয়াই ‘বিদ্যুৎ চুরি কমাও।’ আয় বাড়াতে মাসুলবৃদ্ধির প্রস্তাব সরকার এখন বিবেচনায় আনছে না।
সেই মতো পয়লা ডিসেম্বর থেকে পুলিশ-প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে বর্ধমান-হুগলি-মুর্শিদাবাদ ও দুই ২৪ পরগনা-সহ বিভিন্ন জেলায় বিদ্যুৎ চুরি বন্ধের অভিযানে নামছে বণ্টন সংস্থা। অভিযান চলবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। যদিও সংস্থার কর্তাদের একাংশের প্রশ্ন: চলতি অর্থবর্ষে এখনই যেখানে ৯০০ কোটির বেশি লোকসান হয়ে গিয়েছে, সেখানে চুরি ঠেকিয়ে ‘ক্ষতির ক্ষতে’ আর কতটুকু প্রলেপ দেওয়া যাবে?
এই মুহূর্তে মাসুল বাড়াতে তো রাজ্য নারাজ। তা হলে সুরাহা কী?
বণ্টন-কর্তৃপক্ষের দাবি: চুরি প্রতিরোধ অভিযানে তাঁদের আপত্তি নেই। কিন্তু মাসুল বাড়াতে রাজ্য যখন রাজি নয়, তখন সেই হিসেবে ভর্তুকি দেওয়া হোক। কর্তাদের একাংশের ক্ষোভ: ২০০৮-এর জুন থেকে ’১১-র জুলাই পর্যন্ত দার্জিলিং পাহাড়ে বকেয়া ১০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ-বিল রাজ্য সরকার মকুব করে দিল! অথচ বণ্টন সংস্থা যখন কার্যকরী মূলধন হিসেবে দু’শো কোটি টাকা ভর্তুকি চাইল, তা আদৌ মিলবে কি না, সে ব্যাপারে রাজ্য কোনও আশ্বাস দিল না। উল্টে স্বাস্থ্য-সহ রাজ্য সরকারেরই বিভিন্ন দফতর বিদ্যুৎ বিলের সাড়ে তিনশো কোটি টাকা বণ্টন কোম্পানিকে না-মিটিয়ে ফেলে রেখেছে বলে অভিযোগ। সংস্থা-সূত্রের খবর: সবচেয়ে বেশি টাকা পাওনা রয়েছে বিভিন্ন পুরসভার কাছে। রাজ্য কোষাগারেরও যা হাল, তাতে কবে বকেয়া টাকা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে ঘোরতর সংশয়ে রয়েছে সংস্থা।
বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার পাওনা মেটাতে সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?
রাজ্যের পুর-সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বণ্টন-কর্তৃপক্ষ পুরসভাগুলোর বকেয়া বিল সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। পুর-সচিবের বক্তব্য, “পুরসভার বকেয়া বিল মেটানোর দায় সরাসরি সরকারের হতে পারে না। আবার রাজ্যের তহবিল থেকে যে অর্থ পুরসভাগুলোকে দেওয়া হয়, তা থেকে টাকা কেটে রেখে বিল মেটানোর কোনও অবকাশও দফতরের নেই। তবে এত সবের মধ্যেও কিছু পদক্ষেপ করতে হবে।” একই ভাবে স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তাও বলছেন, “আমাদের কিছু আর্থিক সমস্যা আছে। তবে বাকি বিল সাধ্যমতো মেটানোর চেষ্টা করব।”
এত সবের মাঝে বণ্টন সংস্থার কর্তাদের কাছে একমাত্র আশার আলো, কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ ট্রাইব্যুনালের সেই রায়। কী আছে তাতে?
চলতি মাসে দেওয়া ওই রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, কোনও রাজ্যের সরকার না-চাইলেও সংশ্লিষ্ট রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন একতরফা ভাবে রাজ্যের সরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎ সংস্থাগুকে মাসুল বাড়ানোর নির্দেশ দিতে পারে। সংস্থাগুলোকে তারা বলতে পারে রাজ্য সরকারের মতামত ছাড়াই মাসুল সংশোধনের আবেদন করতে। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি মাথা না-গলায়, তা হলে বণ্টন সংস্থাও মাসুল সংশোধনের আবেদন করতে পারে।
কিন্তু বাস্তবে তা আদৌ সম্ভব হবে কি?
যথেষ্ট সংশয়ে রয়েছেন রাজ্য বণ্টন সংস্থার কর্তারা। |