ভর্তুকির খুঁটি সরে যাওয়ায় রাজ্যের পাঁচ সরকারি পরিবহণ নিগমে এমনিতেই হাঁড়ির হাল।
এমনকী, কর্মীদের বেতনও স্থগিত হয়ে গিয়েছে। অর্থাভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক হচ্ছে না বলে রাস্তায় বাসের সংখ্যা কমেছে, ফলে সংস্থাগুলোর আয় দিন দিন তলানিতে ঠেকছে। অথচ সরকার যাত্রী-ভাড়া বাড়াতে রাজি নয়। অর্থাৎ। বাড়তি আয়ের পথ বন্ধ। এর জেরে সরকারি পরিবহণ যেমন সঙ্কটে, তেমন অনেক রুটে বেসরকারি বাসেরও সংখ্যাতেও টান পড়েছে।
আর এই সব মিলিয়ে ভোগান্তি বাড়ছে আম-যাত্রীর। কিছু কিছু রুটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েও সরকারি-বেসরকারি কোনও বাসের দেখা না-পাওয়াটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা বলে বহু নিত্যযাত্রীর অভিযোগ। পরিবহণ দফতরের এক সূত্রও বলছেন, “সরকারি নিগমগুলোর এমনই হাল যে, কোনও বাস এক বার বসে গেলে তা ফের রাস্তায় নামানোর উপায় নেই। কারণ, মেরামতির টাকা নেই। স্বভাবতই সরকারি বাস দিন দিন ডুমুরের ফুল হয়ে উঠছে।”
|
অন্য দিকে ভাড়া না-বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্তে অখুশি হলেও বেসরকারি বাস-মালিকেরা ধর্মঘটের পথে যাননি। কিন্তু দফতর সূত্রের খবর, নানা ‘অজুহাত’ দেখিয়ে তাঁরা বিভিন্ন রুটে অনেক বাস বসিয়ে দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। অনেকে বলছেন, রাস্তা-ঘাটের যা অবস্থা, তাতে বাস নামালেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অনেকের যুক্তি, যন্ত্রাংশের দাম এত বেড়েছে যে, মেরামতি সাধ্যে কুলোচ্ছে না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
সরকার অবশ্য প্রথমে ব্যাপারটাকে আমল দিতে চায়নি। কিন্তু এখন সরকারি-বেসরকারি, দুই বাসেই টান পড়ায় পরিস্থিতি রীতিমতো ঘোরালো। পরিবহণ-কর্তাদের একাংশের মতে, রাজ্য দু’ভাবে সমস্যার সুরাহা করতে পারত। পরিবহণ সংস্থাগুলোকে ভাড়া বাড়ানোর অনুমতি দিয়ে, কিংবা নতুন বাস কিনে দিয়ে। প্রথম সমাধান-সূত্রটি সরকার খারিজ করেছে। আর দ্বিতীয়টি কার্যকর করা যাচ্ছে না টাকার টানাটানিতে।
রাস্তায় সরকারি বাস কতটা কমছে?
পরিবহণ-সূত্রের তথ্য: সিএসটিসি-র অন্তত অর্ধেক বাস চলার অযোগ্য। এনবিএসটিসি-র ২৯% বাস বসে গিয়েছে। ট্রাম কোম্পানি (সিটিসি)-র সাকুল্যে ৩৯% বাস পথে নামছে। এসবিএসটিসি-র অবশ্য ৬৮% চলনযোগ্য। নিগমগুলোর মধ্যে ভূতল পরিবহণের (ডব্লিউবিএসটিসি) বাস তুলনায় বেশি দেখা যায়, কারণ সেগুলো সবই ব্যক্তিগত মালিকানার।
এত বাস বসে আছে কেন? |
পঙ্গু পরিবহণ (সূত্র: পরিবহণ দফতর) |
সংস্থা |
মোট বাস |
চলছে |
এনবিএসটিসি |
৭০৫ |
৫০০ |
সিএসটিসি (স্বল্প দূরত্ব) |
৮৩৫ |
৪১১ |
সিটিসি |
৩৮০ |
১৫২ |
এসবিএসটিসি |
৪৭০ |
৩২৯ |
|
সিটিসি-র এক কর্তার ব্যাখ্যা, “নতুন বাস কিনতে ৩ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকা চেয়েছিলাম। পাইনি। পুরনো সব বাস সারানোর টাকাও নেই।” ওই কর্তার হিসেব, ক’মাস আগেও টিকিট বিক্রি বাবদ সিটিসি-র রোজ আয় হতো গড়ে ১০ লক্ষ টাকা। এখন তা সাড়ে সাত লক্ষ। বাস যত কমবে, আয়ও তত কমবে। এনবিএসটিসি-র ১০০ বাস খারাপ। ১০০ বাস মেরামতিতে পাঠানো হয়েছে। এ বার পর্যটন-খাতে বরাদ্দের কিছুটা দিয়ে তারা বাস কিনতে চলেছে। এনবিএসটিসি-র মুখ্য হিসাব অফিসার (সিএও) সুমন ঘোষ বলেন, “মেরামতির টাকা নেই। পরিষেবা সচল রাখতে বারোটা বাস কেনার কথা চলছে। প্রতিটার দাম পড়বে প্রায় ১৬ লক্ষ টাকা।”
এ দিকে সরকারি এত বাস বসে যাওয়ায় বহু কর্মীকে যেমন বসিয়ে-বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে, তেমন রোজকার আয়ের অঙ্কও নেমে গিয়েছে বিস্তর। যাকে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ বলে অভিহিত করছেন পরিবহণ দফতরের একাংশ। এক কর্তার কথায়, “পূর্বতন সরকার এক বিশেষজ্ঞ সংস্থাকে দিয়ে সমীক্ষা করিয়েছিল। তারা নিগমগুলোয় অতিরিক্ত কর্মী ছাঁটাইয়ের সুপারিশ করে। বাম সরকার তা কার্যকর করেনি।” নতুন সরকারও অবশ্য সেই পথে হাঁটার উদ্যোগ এখনও দেখায়নি। তবে ‘অবৈধ’ উপায়ে চাকরি পাওয়া লোকজনের খোঁজ শুরু হয়েছে। যদিও তা কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে সম্পর্কে পরিবহণ-কর্তারাই অনেকে সন্দিহান।
বেসরকারি বাস-মিনি মালিকদের যুক্তি কী?
জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটসের যুগ্ম সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফ কথা, “ডিজেল ও যন্ত্রাংশের দাম এবং বিমা-মাসুল প্রচুর বেড়েছে। অথচ ভাড়া বাড়েনি। বাস তো কমবেই!” বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের কর্তা দীপক সরকারের বক্তব্য, “বাম সরকার ডিজেলে লিটারপিছু দু’টাকা ভর্তুকি দেবে বলেছিল। তারা তো দেয়ইনি, বর্তমান সরকারও দিচ্ছে না।”
এ সবেরই খেসারত আমজনতাকে গুনতে হচ্ছে বলে পরিবহণ-মালিকদের দাবি। |