মহেন্দ্র সিংহ ধোনির টিমের বিশ্বকাপ জয়ের মাঠ।
সচিন তেন্ডুলকরের শততম সেঞ্চুরির মহাযজ্ঞের জন্য সাজানো মণ্ডপ।
ব্রায়ান লারা ‘টু’-এর সাড়ম্বর শুভমুক্তির মঞ্চ।
কোনওটা পুরনো স্মৃতিচারণ। কোনওটা আটকে থাকা মাইলস্টোন নিয়ে আকুতি, প্রার্থনা। কোনওটা ক্রিকেট নস্ট্যালজিয়া আর রোম্যান্টিকতার চলমান ছবি। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে ওয়াংখেড়ের বাইশ গজ এবং রবিচন্দ্রন অশ্বিনের করে যাওয়া একটি মন্তব্য।
দিনের খেলা শেষে সাংবাদিক সম্মেলন করতে আসা ভারতের নতুন স্পিন-আবিষ্কার বলে গেলেন, ওয়াংখেড়ের পিচে বাউন্স নেই দেখে নিজেকে প্রতারিত মনে করছেন। অশ্বিনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁদের টিম সিরিজে ২-০ এগিয়ে রয়েছে। সামনে ৩-০ হোয়াইটওয়াশের সুযোগ। যা করতে পারলে টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে দুই নম্বরে উঠে আসা যাবে। সেই পরিস্থিতিতে এ রকম ম্যাড়ম্যাড়ে উইকেট দেওয়া হল দেখে তিনি কি বিস্মিত? হরভজন সিংহের ভবিষ্যৎ কালো মেঘে ঢেকে দেওয়া অশ্বিন বলে দিলেন, “টেস্ট ম্যাচের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনেই বল টার্ন করবে এমন আশা করা যায় না। কিন্তু এই টেস্টে আমি অবশ্যই অনেক ভাল বাউন্স আশা করেছিলাম। সে দিক থেকে দেখতে গেলে নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে।” |
এর পর আরও কিছু কিছু কথা বললেন যেগুলো কম চাঞ্চল্যকর নয়। বললেন, ভারতে রঞ্জি ট্রফি খেলার সময় যেমন দলগুলো প্রথম ইনিংস লিড নেওয়ার জন্য খেলে, এটা সে রকম উইকেট হয়েছে। বললেন, “ওয়াংখেড়েতে আমি আগে অনেক খেলেছি। বরাবর এখানে স্পোর্টিং উইকেট হয়। সেই কারণে আরও আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি! এই নিয়ে অষ্টম ম্যাচ খেলছি ওয়াংখেড়েতে। এ রকম উইকেট কখনও দেখিনি।” চলতি সিরিজেই টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছে তাঁর। জীবনের প্রথম সিরিজের শিক্ষা কী? ফের ওয়াংখেড়ে পিচকে খোঁচা দিয়ে অশ্বিন বললেন, “শিক্ষা এটাই যে, ওভারের পর ওভার বল করার জন্য তৈরি থাকো।” শুনতে-শুনতে মনে হচ্ছিল, এ নিয়ে না দ্রুত বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে যখন সচিন তেন্ডুলকরের শততম সেঞ্চুরির মতো একটা স্পর্শকাতর ব্যাপার এর মধ্যে জড়িত। সবাই বুঝতেই পারছে, মুম্বই ক্রিকেট সংস্থা কেন এত পাটা উইকেট এ বারে তৈরি করেছে। যাতে বিশ্বকাপ জয়ের পর এই কোহিনুরটাও তারা জিতে নিতে পারে। সঞ্জয় মঞ্জরেকর মুম্বইকর হয়েও টেস্টের আগের দিন টুইট করেছেন, ‘শুনলাম ওয়াংখেড়েতে এ বার একেবারে ব্যাটিং উইকেট। বোঝাই যাচ্ছে কেন তা করা হয়েছে।’
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রশাসনিক প্রধান এবং মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার অন্যতম প্রধান কর্তা রত্নাকর শেট্টি অবশ্য পরিস্থিতি হালকা করতে নেমে পড়েছেন। শেট্টি রাতে আনন্দবাজারকে ফোনে বললেন, “শব্দটা শুনলে কানে বাজে ঠিকই। কিন্তু আমার মনে হয় না অশ্বিন ঠিক প্রতারণা অর্থটা বোঝাতে চেয়েছে। বা অন্য কারও দ্বারা প্রতারিত হল সেটা বলতে চেয়েছে। আমার মনে হয় যে, ও বোঝাতে চেয়েছে উইকেটটা দেখে যে রকম মনে হয়েছিল বাউন্স থাকবে সেটা পায়নি।” সঙ্গে যোগ করলেন, “ওরা তো এখানে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলে গিয়েছে। তার পর আইপিএল হয়েছে। অশ্বিন চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে খেলে গিয়েছে। তখন অন্য রকম উইকেট পেয়েছিল। পিচ নিয়ে সেই ধারণাটা এ বারে মেলেনি। সেটাই বোধহয় বোঝাতে চেয়েছে।”
শেট্টির বক্তব্য ক্রিকেটমহলের সর্বত্র শিরোধার্য হবে এমন ভাবার কারণ নেই। ক্রিকেটমহলে কিন্তু শিক্ষিত, পরিণত, ভেবেচিন্তে কথা বলেন বলে অশ্বিনের পরিচিতি আছে। এমনিতে তাঁর কথাবার্তা শুনে কেউ বলবে না যে, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন এক জিনিস। আর বলে ফেলেছেন আর এক জিনিস। আর পিচ নিয়ে এ দিন বারবার তাঁর হতাশার কথা প্রকাশ করে গিয়েছেন তিনি।
পিচ নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কে কিছুটা পর্দার আড়ালে চলে গেল ডারেন ব্র্যাভো নামক নতুন ক্যারিবিয়ান তারকার উদয়। ব্রায়ান লারার সঙ্গে তাঁর যা মিল, বিস্ময়কর! সেই ব্যাকলিফ্ট। সেই শাফ্ল। স্ট্রোক নেওয়ার সময় একই রকম ব্যাট-সুইং। সেঞ্চুরি করে সেলিব্রেশনের একই রকম ভঙ্গিমা। এমনকী নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে ব্যাটে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা দেখেও মনে হবে লারা ফিরে এসেছেন ক্রিকেটে। শুধু প্রাক্তন ক্যারিবিয়ান রাজপুত্র তুলনায় তাঁর ক্লোনের চেয়ে উচ্চতায় খাটো। আর অবশ্যই ক্রিকেটীয় প্রাপ্তির দিক থেকে দু’জনকে এখনও পাশাপাশি বসানোর সময় হয়নি।
কিন্তু শুরুর দিকটা যে আবার হুবহু এক। ইডেন টেস্টে সেঞ্চুরি করে ব্র্যাভো মুম্বইতে নেমেছিলেন প্রথম ১২ টেস্ট থেকে অবিকল লারার মতো পরিসংখ্যান নিয়ে। দু’জনেরই গড় ৪৭.০৫। ১৩তম টেস্টে লারা ১৬৭ করেছিলেন। ব্র্যাভো ওয়াংখেড়েতে থামলেন ২৮৪ বলে ১৬৬ করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে দ্বিতীয় দিনের শেষে ৫৭৫-৯ তুলে মোটামুটি ধোনিদের ৩-০ হোয়াইটওয়াশের রাস্তায় বড়সড় দেওয়াল তুলে দিতে পেরেছে, তার পিছনে ওয়াংখেড়ের পিচ যদি এক নম্বর কারণ হয়, তা হলে খুব কাছাকাছি দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে ব্র্যাভোর ইনিংস। লারা যা পারেননি সেটা তিনি করে দেখালেন। ভারতের মাটিতে কোনও টেস্ট সেঞ্চুরি নেই লারার। ব্র্যাভোর তিন টেস্ট থেকে হয়ে গেল দুটো। দু’জনের মধ্যে কোনও রক্তের সম্পর্ক? ব্র্যাভোর মা আরলিন একবার বলেছিলেন, লারাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁদের বংশের একটা যোগাযোগ আছে।
ক্রিকেটসমাজের কাছে অবশ্য পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে খুব একটা আগ্রহ থাকবে বলে মনে হয় না। বরং আরও জরুরি যোগাযোগ খুঁজে বার করার চেষ্টা করবে। শততম সেঞ্চুরির জন্য সুসজ্জিত মঞ্চেই কি জন্ম নিল লারা-তেন্ডুলকর বংশের নতুন মশালধারী? বচ্চন পরিবারে বেবি বি-র আবির্ভাব ঘটার কাছাকাছি সময়ে আরও এক নবজাতকের চিৎকার কি শোনা গেল মুম্বইয়ে? |
ওয়াংখেড়ের স্কোর |
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংস (আগের দিন ২৬৭-২) |
কার্ক এডওয়ার্ডস ক ধোনি বো ইশান্ত ৮৬
ব্র্যাভো ক ধোনি বো অ্যারন ১৬৬
পাওয়েল ক ধোনি বো প্রজ্ঞান ৮১
স্যামুয়েলস ক দ্রাবিড় বো অশ্বিন ৬১
বাও বো অ্যারন ৪
স্যামি ক ধোনি বো অ্যারন ৩
রামপল ক বিরাট বো অশ্বিন ১০
ফিডেল এডওয়ার্ডস ব্যাটিং ৭
বিশু ব্যাটিং ২
অতিরিক্ত ২৫
মোট ৫৭৫-৯
পতন: ১৩৭, ১৫০, ৩১৪, ৪৭৪, ৫১৮, ৫২৪, ৫৪০, ৫৬৩, ৫৬৬
বোলিং: ইশান্ত ৩০-৯-৭২-১, অ্যারন ২৮-৪-১০৬-৩, প্রজ্ঞান ৪৮-১০-১২৬-১, অশ্বিন ৫১-৬-১৫৪-৪,
সহবাগ ১৬-১-৬১-০, বিরাট ২-০-৯-০, সচিন ৬-০-২৪-০। |
|