আছে শিক্ষকের স্বাভিমান। আছে এমন একটি পরিবেশ যার অনুজ্ঞায় মেধাবী শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের
আচার্যকে সটান লিখতে পারেন, ‘আপনি অযোগ্য, পদ ছাড়ুন।’ অন্য রকম এক চিঠির কথা লিখেছেন
সুমিত চক্রবর্তী |
একটা চিঠি লিখছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া (ডেভিস)-এর ইংরেজি বিভাগের কনিষ্ঠ অধ্যাপক ন্যদান ব্রাউন। লিখছেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার বা চ্যান্সেলার লিন্ডা কাটেহি-কে। কী লিখছেন, তা একটুখানি দেখে নেওয়া যাক: “I am writing to tell you in no uncertain terms that there must be space for protest on our campus...You may not order police to forcefully disperse student protesters peacefully protesting police brutality. You may not do so.”
সহজ, সাবলীল ভাষায় লেখা এই চিঠিতে ন্যদান জানাচ্ছেন, কী কী কারণে তাঁর মতে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের পদত্যাগ করা উচিত। লিখছেন এবং অন্তর্জাল মারফত ছড়িয়ে দিচ্ছেন সারা বিশ্বে। অর্থাৎ প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং ক্ষমতার পরিসীমা সংক্রান্ত তাঁর মতামত, মায় তাঁর উপরওয়ালা সংক্রান্ত সুস্পষ্ট অভিমত তিনি ছড়িয়ে দিচ্ছেন তামাম বিশ্বে। চিঠির শেষ পরিচ্ছেদে লিখছেন : I call for your resignation because you are unfit to do your job. |
ঘটনার প্রেক্ষিত নিয়ে এ বার একটু ছড়িয়ে ভাবি। ‘অকুপাই ওয়ল স্ট্রিট’ মুভমেন্টের খোলা হাওয়া ওয়ল স্ট্রিটের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছু দিন আগেই উত্তাল হয়েছে ইউনিভার্সিট্ অব ক্যালিফর্নিয়ার বার্কলে ক্যাম্পাস। বার্কলের প্রতিবাদী ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের সমর্থনেই জমায়েত হয়েছিলেন ডেভিস ক্যাম্পাসের শিক্ষক ও ছাত্ররা। বেগতিক বুঝে চ্যান্সেলর কাটেহি পুলিশ তলব করেন। তার পরের ঘটনা নির্মম, প্রায় অবিশ্বাস্য। হাতে হাত ধরে মানবশৃঙ্খল তৈরি করে বসে থাকা প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের বিচ্ছিন্ন করতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ লঙ্কাগুঁড়ো স্প্রে করে দিল তাদের চোখে-মুখে, সর্বাঙ্গে। যাঁরা আত্মরক্ষার্থে চোখে কাপড় দিয়েছিলেন, বলপ্রয়োগ করে তাঁদের মুখের ভেতর ঠুসে দেওয়া হল স্প্রে। এই ছবি ইতিমধ্যেই আমরা সকলেই দেখে ফেলেছি।
এই তুলনাহীন নির্মমতায় পৌঁছতে পেরেছেন যে কর্তৃপক্ষ, তাঁরা আমাদের হতবাক করেন। প্রচার মাধ্যমের ডিসকোর্সে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আম-আদমির চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ভাসে, তাতে বল্গাহীন স্বাধীনতা, ইচ্ছে-খুশির লেলিহান উৎসব, গণতন্ত্রের অবাধ উন্মাদনা। আর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর তো উত্তর-আধুনিকতার জোয়ারে ভাসতে থাকা স্বাধীন চেতনার লীলাক্ষেত্র। ন্যদানের বয়ানে অবশ্য উঠে আসে আপাত-স্বাধীনতার অন্দরে সেঁধিয়ে থাকা অন্য এক গল্প: The fact is: the administration of UC campus systematically uses police brutality to terrorize students and faculty, to crush political dissent on our campuses, and to suppress free speech and peaceful assembly.
এ তো গেল পুলিশের সাহায্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দুর্বিনীত নির্মমতার কথা। কিন্তু ন্যদানের খোলা চিঠি শোনাল আর একটি আখ্যান। এক দিকে প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ হলে, অন্য দিকে আবার চাগাড় দেয় প্রতিরোধের ভাষা। এই ঘটনাপ্রবাহ থেকেই উঠে আসে একটা গুরুত্বপূর্ণ আর জটিল সন্দর্ভ। এই চিঠি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ১৯৮৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই বার্কলে ক্যাম্পাসে মিশেল ফুকোর সেই ছ’টি বক্তৃতার কথা ‘ফিয়ারলেস স্পিচ’। ইউরিপিদিস বর্ণিত সেই ‘প্যরহেসিয়া’র প্রকল্প। প্যরহেসিয়া অর্থাৎ ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে সত্যভাষণ।
যে চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক অন্যায় ঘটে গেল এই ডেভিস ক্যাম্পাসে তা যেমন তুলনাহীন, তেমনই অতুলনীয়। ঘটনার পিঠোপিঠি চ্যান্সেলর কাটেহিকে লেখা ন্যদানের এই খোলা চিঠি। নিঃসন্দেহে এই চিঠি একটা সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান। তিনি কোন দিকে তা জানিয়ে দেওয়া। ন্যদান সেই সব ছাত্র-শিক্ষকের সঙ্গে আছেন যাঁরা জানেন ‘how to speak truth to power. That is what I am doing.’ যেটা আমাদের খেয়াল করবার, তা হল, এই রাজনৈতিক অবস্থানে কোনও দলতন্ত্র নেই। ঝান্ডা নিয়ে স্লোগানবাজি নেই। ফাঁকতালে দলতান্ত্রিক আধিপত্য কায়েম করার প্রচেষ্টা নেই। কোনও কিছুকেই ভেঙে বা গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভব্যতা নেই, যেটা আছে তা হল অসম্ভব ক্রোধ। আর সেই ক্রোধের গণতান্ত্রিক প্রকাশ। যেখানে এক জন কনিষ্ঠ অধ্যাপক তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্সেলরকে খোলা চিঠিতে জানাতে পারেন: As such, I call upon you to resign immediately.
এই চিঠির অন্তর্নিহিত স্পর্ধায় বার বার ধ্বনিত হয় নিজের অবস্থান সম্বন্ধে এক জন অধ্যাপকের স্পষ্ট ধারণা আমি কে, এবং কেন আমি এখানে রয়েছি। সেই আত্মশ্রদ্ধা থেকে উঠে আসে এই চিঠির প্রতিটি উচ্চারণ। তাঁর পরিবেশ তাঁকে এই অনুজ্ঞা দিয়েছে যে, শুধুমাত্র মেধার উপর ভর করে রাজনৈতিক অবস্থানের বাইরে এসে এই চিঠি লেখা সম্ভব তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। যেমন লিখেছেন ইংরেজি বিভাগের এই অধ্যাপক: I am an asset to the University of California at Davis. You are not.
চ্যান্সেলরকে লেখা ন্যদানের এই বয়ান কি আমাদের ভাবায়? শিক্ষককুলের আশু কতর্ব্য সম্বন্ধে আমাদের কি নতুন করে কিছু ভাবতে বলে?
হয়তো বা।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক |