এক দিন অতলান্তিক মহাসাগরের অধিকারের জন্য তীব্র লড়াই লড়তে হয়েছিল আমেরিকাকে।
আজ সে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা চায়। এশিয়া
ও অস্ট্রেলিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার সাম্প্রতিক সফরের তাৎপর্য খুঁজেছেন
সেমন্তী ঘোষ |
এত দিনে তা হলে অশান্ত মহাসাগরই বলা চলে একে। যে মহাসাগরের এক দিকে মার্কিন দেশ, আর এক দিকে চিন, যে মহাসাগরের ওপর দিয়ে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের বাণিজ্য চলে প্রতি বছর, যে মহাসাগরের তলদেশে নাকি খনিজ তেলের অপার সম্পদসম্ভার, সেই মহাসাগরের অন্য কী নামই বা হতে পারে? সুতরাং এই মহাসাগর জুড়ে যে অশান্তির মেঘের ঘনঘটা, এটা কোনও বড় খবর নয়। বড় খবর কেবল এইটুকুই, এত দিন এই মহাসাগর-কাহিনি ছিল সভ্যতা-ইতিহাসের খাতার ভেতরের পাতায় লুকোনো: এ বার ইতিহাসের সেই পৃষ্ঠাটি অবশেষে খোলা হয়েছে। অনুচ্চারিত, প্রচ্ছন্ন পশ্চাৎপট থেকে অবশেষে আত্মপ্রকাশ করেছে পরবর্তী বিশ্ব-রাজনীতির প্রধান মঞ্চ। সন্দেহের অবকাশ নেই, প্রশান্ত মহাসাগরেই ঘটতে চলেছে একুশ শতকের জমজমাট কূট-নাটকের পালা।
বেশি তথ্য দরকার নেই। নভেম্বর মাসের মার্কিন বিদেশ নীতির গতিবৃত্তটি লক্ষ করলেই স্পষ্ট হয় ছবিটা। ১২-১৪ তারিখে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে ব্যস্ত ছিলেন। ১৬-১৭ তারিখে অস্ট্রেলিয়ায় উপস্থিত হয়ে সে দেশের সঙ্গে নতুন চুক্তি করছিলেন। ১৮ তারিখে সেখান থেকে সোজা ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে অবতীর্ণ হলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন কিংবা বন্ধুত্ব জোরদার করার বাসনা নিয়ে। মহাসাগর ঘিরে চক্র-গতিপথে একের পর এক কূটনৈতিক লক্ষ্য বিদ্ধ করে ফিরে গেলেন তিনি। |
প্রথমে হাওয়াইয়ের কথাই ধরা যাক। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে আয়োজিত এশিয়া প্যাসিফিক ইকনমিক কো-অপারেশন ফোরাম (APEC)-এর মঞ্চে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে দেখা গেল প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের হালচাল নিয়ে প্রবল উদ্বেগ প্রকাশ করতে। বাস্তবিক, যে শব্দবন্ধ তিনি সেই বৈঠকে ব্যবহার করলেন ‘এনাফ ইজ এনাফ’ এতখানি অধৈর্যের উচ্চারণ সাধারণত তাঁর বক্তৃতায় পাওয়া যায় না। কার সম্বন্ধে এই মন্তব্য? অবশ্যই চিন। কোন প্রসঙ্গে? প্রশান্ত মহাসাগরে চিনের আধিপত্য বিস্তারের প্রয়াস প্রসঙ্গে।
এর পর অস্ট্রেলিয়ায় দেখা গেল অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-ইউনাইটেড স্টেটস (ANZUS) ডিফেন্স ট্রিটি-র সুবর্ণজয়ন্তী পালন, তৎসূত্রে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন নতুন চুক্তিসাধন। সেই সব চুক্তির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনটি? অবশ্যই পরের বছর থেকে অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে ডারউইন শহরে মার্কিন নৌবাহিনী মজুত রাখার সিদ্ধান্ত। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অন্তত ২৫০ রণতরী ও ২৫০০ নৌ-সেনার উপস্থিতি এই অঞ্চলে নিশ্চিত করতে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এই প্রতিশ্রুতি। চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে যাওয়ার পরই অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা হাসিমুখে জানালেন না, কোনও বিশেষ দেশের প্রতি উদ্দিষ্ট নয় তাঁদের নতুন পরিকল্পনা। এই সর্বৈব কূট-বাক্যটির পিছনে আসল সত্যটি অবশ্য প্রায় সর্বজ্ঞাত। সেই সত্যের নাম: চিন। আর সেই জন্যই, ‘উই ওয়েলকাম আ রাইজিং পিসফুল চায়না’, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে এই দরাজ ঘোষণার ফাঁকেই ত্বরিত দৃঢ়তায় ওবামা গুঁজে দেন আরও একটি বাক্য: “তবে এ কথাও স্পষ্ট ভাবে চিনকে জানিয়ে দেওয়া দরকার, যদি তারা বিশ্ব-কূটনীতির বৃহৎশক্তি হয়ে উঠতে চায়, সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম ও দায়িত্বগুলিও তাদের সর্বদা মেনে চলতে হবে...” যে বাক্যটি তিনি উহ্য রাখলেন এ ক্ষেত্রে, তা হল, মার্কিন দেশ ও তার মিত্রশক্তিরা আন্তর্জাতিক নিয়ম ও চুক্তি হিসেবে যা নির্ধারণ করবে, সেগুলিই চিনকে মানতে হবে, কোনও ছাড়ান নেই। প্রসঙ্গত, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যে চুক্তির নবীকরণ হল, তাতে বলা আছে: অন্য কোনও শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হলে এই দুটি দেশ পরস্পরকে সমস্ত রকম সহায়তা দিতে বাধ্য।
তবে, ওবামার সবচেয়ে বড় তৎপরতা দেখা গেল বালিদ্বীপে। অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনস (ASEAN)-এর বৈঠকে তাঁর যোগদানটাই অবশ্য তাঁর প্রবল তৎপরতার প্রধান দৃষ্টান্ত। প্রতি বছরে দু’বার করে আসিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি একত্র হয়; কিন্তু সেই আসিয়ান-মঞ্চে এই প্রথম বার যোগদান করল ওবামার দেশ। প্রথম বার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক আলোচনার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের প্রত্যক্ষ ‘স্বার্থ’-র কথা ঘোষণা করে সরাসরি আসিয়ান-এ অংশ নিল। স্বভাবতই, এই স্বার্থ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগর-সংক্রান্ত স্বার্থ। স্বভাবতই, স্বার্থরক্ষা নিয়ে এই চিন্তা চিনের ক্ষমতা প্রসারের গতিপ্রকৃতি থেকে সঞ্জাত চিন্তা।
এ বারের আসিয়ান বৈঠকের প্রধান আলোচ্য ছিল দক্ষিণ চিন সমুদ্র। প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পূর্বাংশের এই সমুদ্রটি চিন, অস্ট্রেলেশীয় দ্বীপপুঞ্জ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে অনেক কাল ধরেই বিসম্বাদের বিশিষ্ট ক্ষেত্র। পশ্চিমে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, দক্ষিণে ফিলিপিনস, ব্রুনেই, উত্তরে তাইওয়ান এবং স্বয়ং চিন সব কয়টি দেশের বাণিজ্যের তীব্র প্রবাহ এই সমুদ্র জুড়ে, যার নীচে লুকিয়ে রয়েছে ২১.৩ হাজার কোটি ব্যারেল পরিমাণ খনিজ তৈল ও গ্যাস সাক্ষাৎ সোনার খনি। সমুদ্রটির দুই-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি চিনের দখলে, বাকি এক-তৃতীয়াংশে চিন প্রত্যহ আরও একটু ক্ষমতা প্রসারে সদাব্যস্ত। সবচেয়ে বেশি তেলসমৃদ্ধ অংশটিতে অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জ, যার নাম স্প্র্যাটলি আইল্যান্ডস। এই দ্বীপপুঞ্জের ওপর ফিলিপাইনস-এর দাবি সবচেয়ে বেশি, ভিয়েতনামের দাবিও কম নয়। কিন্তু চিন যেহেতু একমাত্র আঞ্চলিক মহাশক্তি, এবং তার প্রযুক্তি-তৎপরতার মাধ্যমে সে-ই যেহেতু এ যাবৎ স্প্র্যাটলি দ্বীপসমূহের সম্পদের সন্ধান করে এসেছে, সুতরাং তার দাবি ঠেকায় কে। বাস্তবিক, স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে সামুদ্রিক সংঘাত দক্ষিণ চিন সমুদ্রে প্রায় প্রাত্যহিক, যার খুব কম খবরই দুনিয়ার প্রচারমাধ্যম পর্যন্ত এসে পৌঁছয়।
কিছু কিছু ঘটনা তবুও চাপা থাকে না। যেমন, গত মাসের একটি ঘটনা। ফিলিপাইনসের একটি নৌকাদলের উপর অবিরত গোলাবর্ষণ করল চিনা যুদ্ধজাহাজ, ফিলিপিনো নৌকোগুলি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হল, প্রচুর প্রাণহানি ঘটল। অন্য সময় হলে হয়তো বিশ্ব-বিস্মৃতির অতলে সহজেই তলিয়ে যেত এই ঘটনা। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটল ঠিক তার পর পরই আসিয়ান বৈঠক বসার কারণে। ফিলিপাইনস-এর এত বড় সংকটের প্রেক্ষিতে যখন বালি-তে দেখা গেল প্রেসিডেন্ট ওবামা ও ফিলিপিনো প্রেসিডেন্ট বেনিনো আকিনো মূল বৈঠকের আগেই নিবিড় কথোপকথন ও প্রতিশ্রুতি আদানপ্রদানে অত্যন্ত ব্যস্ত, তখনই কিন্তু মার্কিন অ্যাজেন্ডা ও সেই অ্যাজেন্ডায় চিনের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়। আসিয়ান বৈঠকে মার্কিন যোগদানের সময়টি যে বিশেষ সুনির্বাচিত, সেটা বোঝা যায়। প্রসঙ্গত, মার্কিন দেশের সঙ্গে ফিলিপাইনস-এর চুক্তিরও ষাট বছর পূর্ণ হল এ বছর, এবং দুই দেশনেতার হীরকজয়ন্তী আলোচনায় প্রতিশ্রুত হল ‘looking out for each other when it comes to security.’
অর্থনীতির জন্যই তো রাজনীতি। সুতরাং, আসিয়ান-এর বৈঠকে ওবামা একটুও সময় নষ্ট না করে একের পর এক দেশকে আলোচনা টেবিলে বসিয়ে গেলেন: যে তালিকায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি নাম ভিয়েতনাম ও মায়ানমার। নতুন করে প্রতিরক্ষা আলোচনার খসড়া তৈরি হল ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে। ঠিক হল, ভিয়েতনামে পড়ে-থাকা পুরনো মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলির কয়েকটির পুনর্নির্মাণ হবে। বিচিত্র ইতিহাসের গতি: চল্লিশ বছর আগেও যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি থেকে গোলা ধেয়ে আসত ভিয়েতনামকে চুর্ণ করতে, আর প্রতি-আক্রমণের জন্য চিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত ভিয়েতনাম, আজ চিনের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামকে ‘রক্ষা’ করতে সেই মার্কিন ঘাঁটি নতুন করে তৈরি হতে চলেছে!
ইতিহাসের গতি বিচিত্র হলে অর্থনীতির গতি হল অমোঘ! অর্ধশতক ধরে মায়ানমারের সামরিক সরকারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে ওয়াশিংটন, আর সেই অবকাশে ক্রমশ বেজিং-এর উপগ্রহে পরিণত হয়েছে ইয়াঙ্গন। কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগেই যেন ভবিষ্যৎ-দর্পণে দেখা গিয়েছিল, মার্কিন সিদ্ধান্ত এক দিন পাল্টাতে হবে চিনের জন্যই; চিনের অর্থনীতি যে দিন মহা-অর্থনীতি হয়ে আমেরিকার সঙ্গে টক্কর দেবে, মায়ানমারের মতো দেশকে সে দিন অবহেলা করতে পারবে না ওয়াশিংটন। ২০১১ সাল দেখল সেই অমোঘ অর্থনীতির পথপরিক্রমার শেষ: আসিয়ান বৈঠক চলাকালীন প্রেসিডেন্ট ওবামার ঘোষণা, পরের মাসেই তাঁর বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন যাবেন ইয়াঙ্গন সফরে, সেখানে সামরিক শাসনের কব্জা আলগা করে যে গণতন্ত্রের ইশারা দেখা দিতে শুরু করেছে, তাকে স্বাগত জানাতে।
অবশ্যই ক্লিন্টনের এই সফর পছন্দ করবে না চিন। ঠিক যেমন, তাইওয়ান প্রশ্নে মার্কিন নীতি নিয়েও চিনের আপত্তি আছে। তাইওয়ানের উপর চিনের দাবি মেনে নিলেও সে দেশে চিনের কোনও সামরিক অভিযান সমর্থন করবে না আমেরিকা এটা বেজিংয়ের অপছন্দ। তেমনই, উত্তর কোরিয়ার পরমাণু-শক্তি বিষয়ে চিনের যথেষ্ট উদ্বেগ সত্ত্বেও মার্কিন নেতৃত্বে পিয়ংইয়ঙের উপর আন্তর্জাতিক চাপসৃষ্টিতে কোনও মতেই সাহায্য করতে রাজি নয় চিন।
সমস্যা হল, এই সব কয়টি দেশই যে একটি মহাসাগরেরই পার্শ্ববর্তী। অগ্নিগর্ভ ‘প্যাসিফিক রিম’ ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আপাতত তাই নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু। ওবামার ভাষায়: Let there be no doubt. In the Asia-Pacific in the 21st century, the US is all in. ওয়াশিংটনে প্রশ্নজর্জর মার্কিন জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির কর্তা বেন রোডস যতই বলুন না কেন, We do not see our engagement in the region coming at the expense of China, কথাটা ‘আমি তো কলা খাইনি’-র মতো শুনতে লাগবেই।
একমেরু বিশ্ব দ্রুত দ্বিমেরু হওয়ার দিকে এগোচ্ছে, আর দ্রুত পাল্টাচ্ছে দুই মেরুদেশ-সংলগ্ন মহাসাগরের আবহাওয়া। এক দিন অতলান্তিক মহাসাগরের অধিকারের জন্যও তীব্র লড়াই লড়তে হয়েছিল মার্কিন দেশকে। ইতিহাসের পরিহাস, আজ তাকেই কি না দৃপ্ত স্বরে ঘোষণা করতে হচ্ছে “The US has been, and always will be a Pacific nation...” (ওবামা, ১৭ নভেম্বর)। পৃথিবী পশ্চিম থেকে পুবে ঘুরছে পরিষ্কার! |