বছরভ’র ট্রেন দুর্ঘটনার বিরাম নাই। এই সব ঘটনা প্রধানত রেলপথের ত্রুটি, ত্রুটিপূর্ণ সিগনাল ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঘটিয়া থাকে। পাশাপাশি চলন্ত ট্রেনের কামরায় অগ্নিকাণ্ডও প্রায়শ ঘটিতেছে। সমস্যা এ ক্ষেত্রে রেলপথের নয়, ট্রেনের কামরাগুলির অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থার, বিশেষত শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বগিগুলির রক্ষণাবেক্ষণের। ত্রুটিগুলি ‘যান্ত্রিক’ বলিয়া অভিহিত হয়, কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাহার পিছনে থাকে মানুষের (প্রধানত ভারপ্রাপ্ত মেকানিক ও নিরাপত্তাকর্মীদের) অবহেলা ও উপেক্ষা। দেরাদুনগামী দুন এক্সপ্রেসের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বগির অভ্যন্তরে সোমবার রাত্রের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানিবার জন্য যথাযথ তদন্ত জরুরি, কিন্তু এই ঘটনাও যে পরিচিত পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত, তাহা মনে করিবার বিলক্ষণ হেতু আছে।
কারণ যাহাই হউক, তাহার দায়িত্ব অবশ্যই রেল কর্তৃপক্ষ ও রেল নিরাপত্তা বিভাগের উপরেই বর্তায়। ভারতীয় রেলের অকর্মণ্যতা এ ধরনের ঘটনায় বহু বার প্রকট হইয়াছে। যাত্রীদের ধারণা হইয়াছে যে, নিরাপত্তার বিষয়টি রেলের অগ্রাধিকার তালিকার একেবারে নীচে আসিয়া ঠেকিয়াছে। নূতন-নূতন ট্রেন-এর ‘উদ্বোধন’ হইয়াছে, ঘটা করিয়া যন্ত্রগণক চালিত টিকিট কাউন্টারও চালু হইয়াছে। আর প্রায় এক দশক যাত্রী-ভাড়া বাড়িতে দেওয়া হয় নাই। কিন্তু রেলের পরিষেবা উন্নত করার যথেষ্ট কর্মসূচি গৃহীত হয় নাই। যাত্রী-নিরাপত্তা সেই পরিষেবারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু তাহা নিশ্চিত করিতে যে-সব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ক্রয় করিতে হয়, সে-জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান হয়তো লোকসানে-চলা রেল দফতরের সাধ্যাতীত। রেলকে নিজের খরচ নিজে তুলিবার জন্য চাপে রাখার সিদ্ধান্তও ভারপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধারণায় কোনও পরিবর্তন ঘটায় নাই। যখন যিনি রেলমন্ত্রী হইয়াছেন, তখন তিনি নিজ দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি রূপায়ণের এবং প্রতিপক্ষ দলকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়ায় মজিয়া থাকিয়াছেন। ফলে ভারতীয় রেল কিছুতেই সাবালক হইতে পারে নাই। ঘন-ঘন দুর্ঘটনা ও তাহাতে বহু নিরীহ যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর মৌন মিছিল অবিরত।
অপ্রতুল পরিকাঠামোর সহিত যুক্ত হইয়াছে কর্মীদের অক্ষমতা বা ফাঁকি। দুন এক্সপ্রেসের ক্ষেত্রে যেমন অভিযোগ শোনা গিয়াছে যে, এসি-মেকানিক তথা নিরাপত্তা কর্মীদের অনুপস্থিতি দুর্ঘটনার ভয়াবহতা বাড়াইয়া দেয়। যান্ত্রিক গোলযোগ সারাইবার জন্য এসি কোচে মেকানিক থাকা অত্যাবশ্যক। কিন্তু যেমন যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য রেলরক্ষীদের প্রায়শই পাওয়া যায় না, তেমনই ওই মেকানিকরাও প্রয়োজনের সময় গরহাজির। ফলে দুষ্কৃতীরা যেমন রক্ষীহীন কামরায় যথেচ্ছ অনধিকার প্রবেশ করিয়া যাত্রীদের নিগ্রহ, মহিলাদের শ্লীলতাহানি করে, তেমন ভাবেই এসি-কামরা জ্বলিতে থাকিলেও তাহা নিভাইবার লোক পাওয়া যায় নাই। জনৈক যাত্রীই তাঁহার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে চেন টানিয়া চলন্ত ট্রেনটি থামাইয়া না দিলে আগুন যেমন আরও ছড়াইয়া পড়িত, আরও বহু যাত্রীও তেমনই হতাহত হইতেন। কর্মীদের দায়বদ্ধ করার সময় এখনও আসে নাই? নিরাপত্তা ও পরিষেবার বিভিন্ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অফিসারদের জবাবদিহিই বা চাওয়া হয় না কেন? কেনই বা রেলমন্ত্রীরাও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে? বর্তমান রেলমন্ত্রী ঘটনার অব্যবহিত পরেই অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনার কথা উচ্চারণ করিয়াছেন। আর কিছু না হোক, বাক্সংযমটুকু অভ্যাস করিলে হয় না? |