অভিযোগটি গুরুতর রাজ্য প্রশাসন নাকি গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করিতে সচেষ্ট। এই ভয়ানক অপচেষ্টার প্রতিবাদে মহানগর সরগরম। উপলক্ষ: কলিকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলাস্থিত ‘মেট্রো চ্যানেল’-এ কিছু মানবাধিকার সংগঠনের একটি সভা করিবার প্রয়াসে প্রশাসনিক অসম্মতি। সভাটি, শেষ পর্যন্ত, হয় নাই। তাহার পরেই উক্ত অভিযোগের উৎপত্তি। অভিযোগটি জনতার সেই অংশের বক্তব্য, যাঁহারা সেই দিন ধর্মতলায় সভা করিতে ইচ্ছুক ছিলেন। অথচ, জনতার আরও একটি অংশ আছে। যাঁহারা সংশ্লিষ্ট সময়ে ধর্মতলা চত্বর এবং তাহার সন্নিকটে নানা অঞ্চলে বিদ্যমান ছিলেন, অথচ, এই সভার সহিত যাঁহাদের কোনও সংস্রবই ছিল না। একটি পূর্ণ কর্মদিনে কলিকাতার কেন্দ্রে সভাটি না-হইবার ফলে তাঁহাদের যাতায়াতের দুর্ভোগ ঈষৎ কম হইয়াছে। এই বিশেষ সভাটি শুধু নহে, ওই এলাকায় কোনও পথসভা না হইলেই তাঁহারা বিপুল স্বস্তিবোধ করিয়া থাকেন। রাজনীতিসচেতন বঙ্গজনতার পরাক্রমে রাজপথে অ-স্বস্তিই বেশি থাকে অবশ্য! অনুমান করা চলে, যাঁহারা মেট্রো চ্যানেলাদি জনস্থানে আপন সচেতনতা জাহির করিতে চাহেন, তাঁহাদের তুলনায় জন-সাধারণের সংখ্যা কিঞ্চিৎ বেশি, যে জনসাধারণ নির্বিবাদে নির্ঝঞ্ঝাটে শহরে যাতায়াত করিতে চাহেন। জনতার এই বৃহত্তর অংশটি কি গণতন্ত্রের আওতার বাহিরে? গণতন্ত্র কি কেবল মেট্রো চ্যানেল-অন্ত-প্রাণ প্রতিবাদীদিগের জন্য? ‘গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ’ বলিয়া ধর্মতলা মাথায় করিবার আগে প্রশ্নটি বিবেচনা করা দরকার।
অন্তত এক দিন মেট্রো চ্যানেল মুক্তি পাইয়াছে, ইহা আনন্দের কথা। কিন্তু গভীর প্রশ্নটি হইল, এই ধরনের সভার অনুমতি আদৌ কেন দেওয়া হইবে? কেবল মেট্রো চ্যানেল নয়, শহরের যে কোনও স্থানে এক মুহূর্তের জন্যও এক ইঞ্চি পথ রোধ করিবার অধিকার কাহারও নাই। এই সহজ এবং স্পষ্ট কথাটিই প্রশাসনের জানাইয়া দেওয়া কর্তব্য যে, পথ আটকাইয়া কেহ কিছুই করিতে পারিবেন না। এই সামগ্রিক নীতিটি ঘোষিত এবং বলবৎ হইলে প্রশাসনও পক্ষপাতিত্ব বা অস্বচ্ছতার মতো অপরাধের অভিযোগ হইতে অব্যাহতি পাইবেন। কে আগে অনুমতি লইয়াছে, কী রূপে লইয়াছে, কে পরে আবদার করিল, এই সকল প্রশ্ন তখন অপ্রাসঙ্গিক হইয়া পড়িবে, ‘আমরা-উহারা’ ইত্যাদি ভূত খুঁজিয়া বেড়ানোর অবকাশ থাকিবে না। ইহা নীতির প্রশ্ন। দুঃখের বিষয়, সেই কথাটি বলা হয় নাই। প্রশাসন একটি জরুরি কাজ করিয়াছে, কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় তাহা করা উচিত ছিল, সেই প্রক্রিয়াটি যথাযথ রূপে চলে নাই।
কেন চলে নাই, তাহা বুঝা কঠিন নহে। নগর-প্রশাসন বিপর্যস্ত হইবে, সুতরাং পথ আটকাইয়া সভা করা চলিবে না, এই কঠিন সত্যটি সটান জানাইবার মানসিকতা এখনও পর্যন্ত তৈয়ারি হয় নাই। রাজনীতিকরা ইহা আজও বিশ্বাসই করিতে পারেন নাই যে, রাস্তার রাজনীতি গণতান্ত্রিক রাজনীতি নহে। এই অ-বোধ কার্যত সমস্ত দলেরই মজ্জাগত। সেই কারণেই কথায় কথায় বিধানসভা বা সংসদের অধিবেশন বয়কট করা হয়, সংসদীয় বিতর্কের পরিবর্তে ময়দানের তরজা চলিতে থাকে, তৎসহ বন্ধ, অবরোধ, রেল রোকো, রাস্তা রোকো ইত্যাদি ষোড়শোপচারে ‘গণতন্ত্র’র আরাধনা চলে। ইহা প্রকৃত গণতন্ত্র নহে, ইহা রাস্তা-তন্ত্র। গণতন্ত্র অবশ্যই প্রতিবাদের অধিকার দেয়। মানবাধিকারের দাবিতে প্রতিবাদের অধিকার নিশ্চয়ই গণতান্ত্রিক অধিকার, এমনকী মাওবাদীদের মানবাধিকারও অবশ্যই মূল্যবান, গণতন্ত্রের স্বার্থেই মূল্যবান। কিন্তু সেই প্রতিবাদ জানাইবার জন্য জনপথ অবরোধের কোনও অধিকার মান্য নহে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি সত্যই পরিবর্তন আনিতে চাহেন, এই কথাটি তাঁহাকে সাহস করিয়া বলিতে হইবে। তাহাকেই রাজনৈতিক সাহস বলে। |