|
|
|
|
‘পথের কাঁটা’ সিস্টারকে হত্যার কথা কবুল প্রাক্তন ‘ডান হাতে’র |
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় • পাকুড় |
পানেম কয়লাখনির জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যে ছিল তাঁর ‘ডান হাত’, সেই-ই সিস্টার ওয়ালসাকে খুন করেছে বলে দাবি পাকুড় জেলা পুলিশের। পাইসিল হেমব্রম নামের সেই সাঁওতাল যুবক আপাতত পুলিশি হেফাজতে। পাকুড়ের পুলিশ সুপার অমরনাথ খন্না বলেন, “জেরার মুখে আমাদের কাছে সিস্টারকে খুনের কথা কবুল করেছে পাইসিল। তবে সে একা নয়, ওই রাতে অনেকে মিলে সিস্টারের বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল।”
এ বছর জুলাই মাস পর্যন্ত পাচুয়াড়া গ্রামে পাইসিলের বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন সিস্টার ওয়ালসা। পরে পাইসিলই হুমকি দিয়ে সিস্টারকে ঘর থেকে বের করে দেয়। সিস্টারের ঠাঁই হয় মুন্সি ও সোনারাম হেমব্রমের বাড়িতে। তাঁর প্রাণহানির আশঙ্কার কথাও দুই ভাইকে বলেছিলেন সিস্টার। ঘনিষ্ঠ আদিবাসী যুবকরা সিস্টারকে পাহারা দিতেন। ১৪ নভেম্বর রাতেও তাঁরা ছিলেন। কিন্তু ৪০-৫০ জন একসঙ্গে হামলা করায় প্রতিরোধ করতে পারেননি তাঁরা। পুলিশ সুপারের দাবি, “এলাকার আদিবাসীদের একাংশকে সিস্টারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছিল পাইসিল-ই। ওরই প্ররোচনায় সিস্টারের বাড়িতে হামলা হয়।” পাইসিল এবং এলাকার আরও কয়েক জনের অবৈধ লেনদেনের ক্ষেত্রে ‘কাঁটা’ হয়ে ওঠাতেই সিস্টারকে খুনের ছক কষা হয়। তবে এখনও পর্যন্ত কয়েকটি পোস্টার ছাড়া ঘটনার সঙ্গে মাওবাদী যোগাযোগের প্রমাণ পায়নি পুলিশ।
আমড়াপাড়া থেকে কাঁঠালডিহি, ১৬ কিলোমিটার পথের দু’ধারে শাল-মহুয়ার জঙ্গল। পথের শেষে বেসরকারি ‘পানেম কোল মাইনস লিমিটেড’। আজ যে পানেম-ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ উঠছে নিহত খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনীর বিরুদ্ধে, তিনিই এক সময় ওই কয়লা খনির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এলাকায় ভগবানের মর্যাদা পেয়েছিলেন। পাশে ছিলেন পাচুয়াড়া, আলুবেড়া, রাঙা, টমকি, সিংদহরি-সহ ৯টি গ্রামের বাসিন্দারা। আন্দোলনে সিস্টারের ডান হাত হয়ে উঠেছিল পাইসিল।
আদিবাসীদের সামাজিক, আর্থিক উন্নয়নের দাবি তুলে পানেম গোষ্ঠীর জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত মামলা করেছিলেন সিস্টার। মামলায় হেরে যান সিস্টাররা। ২০০৬ সালে শীর্ষ আদালতের নির্দেশে কাঁঠালডিহিতে ২৮০০ হেক্টর জমির উপরে ৯টি মৌজা জুড়ে পানেম কয়লাখনি চালু হয়। সেই সময় জমির বাজারদর অনুযায়ী জমিহারা আদিবাসীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা, জমিদাতা পরিবারের সদস্যদের চাকরি, এলাকায় স্কুল-হাসপাতাল-রাস্তা তৈরির দাবি তুলে সিস্টার ওয়ালসার নেতৃত্বে নতুন করে আন্দোলন সংগঠিত করেন আদিবাসীরা। পুলিশের দাবি, আন্দোলনের এই পর্যায়েও সিস্টারের সঙ্গেই ছিল পাইসিল। এর পরেই দূরত্ব বাড়তে থাকে। বিভিন্ন নির্মাণকাজের ঠিকাদারির বরাত পাওয়ার জন্য সক্রিয় হয় পাইসিলরা। বাধা দিতে থাকেন সিস্টার। বস্তুত সিস্টার ওয়ালসা যে ঘরে খুন হয়েছেন, সেই ঘরে রাখা ফাইলে মিলেছে খনি এলাকার রাস্তা নির্মাণ, নালা সংস্কার, কর্মী আবাসন ও স্টোর নির্মাণ সংক্রান্ত ২০০৮ সালের নানা ‘ওয়র্ক অর্ডার’-এর ফটোকপি। সেই সব ‘ওয়র্ক অর্ডার’-এর অধিকাংশই পাইসিল, টালা হেমব্রম আর প্রেম টুরির নামে। পাইসিলদের ‘অপপ্রচারের’ মোকাবিলায় সিস্টারের ‘অস্ত্র’।
পুলিশের দাবি, বরাত পাওয়ার ক্ষেত্রে পাইসিলদের পথের কাঁটা হয়ে উঠেছিলেন সিস্টার ওয়ালসা। কোন কাজ হবে, কোথায় হবে তা পানেম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিস্টারই ঠিক করতেন। পানেম গোষ্ঠীর ম্যানেজার রণজিৎ রায়ও বলেন, “সিস্টারকে মাঝে মাঝেই আদিবাসীদের দাবিদাওয়া নিয়ে খনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে দেখেছি।” পুলিশ সুপার বলেন, “সিস্টার খুনের পিছনে লাভ-ক্ষতির অঙ্ক জড়িয়ে রয়েছে। সব দিক বিবেচনা করেই তদন্ত চলছে।” |
|
|
|
|
|