দুন এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ডের পরেই দিল্লিতে রেলমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তার ক’ঘণ্টার মধ্যেই দেশের দু’প্রান্তে পরের পর ঘটে গেল আরও দু’-দু’টো রেল দুর্ঘটনা!
এবং দুই জায়গায় কারও মৃত্যু না-হলেও আহত হয়েছেন ৩১ জন। রেল-সূত্রের খবর: দু’টো দুর্ঘটনাই বড় মাপের হতে পারত। বস্তুত মঙ্গলবার রাতে ওড়িশার ঝাড়সুগুদা ও কাশ্মীরের কাজিগুন্দে ওই দুই ট্রেনের যাত্রীরা রক্ষা পেয়েছেন অল্পের জন্য।
দুন-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার রাতে দিল্লিতে রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুর্ঘটনা এড়ানোর বিবিধ পন্থা নিয়ে তাঁদের আলোচনা হয়। এর পরেই দেশের সব ক’টি জোনে ‘নিয়ম মেনে ও সাবধানে’ ট্রেন চালানোর নির্দেশ পাঠায় রেল মন্ত্রক। কিন্তু ওই রাতেই দুর্ঘটনার খবর আসে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ঝাড়সুগুদা থেকে। রেলকর্তারা জানাচ্ছেন, রাত দু’টো নাগাদ হাওড়ামুখী কোরাপুট এক্সপ্রেস সিগন্যাল লাল থাকায় দাঁড়িয়েছিল স্টেশনের বাইরে, পয়েন্টের (এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যাওয়ার ক্রসিং) কাছে। পাশাপাশি লাইনে ছিল একটি মালগাড়ি। প্রথমে মালগাড়িকে সিগন্যাল দেওয়া হয়। মালগাড়ির চালক ট্রেন চালাতে শুরু করেন। এর মধ্যেই আচমকা কোরাপুটের চালকও ট্রেন চালিয়ে দেন। ঘটে যায় বিপত্তি। |
কোরাপুটের যাত্রীরা জানান, ট্রেন দু’টো পয়েন্টের কাছে এসে পরস্পরের গায়ে লেগে ঘষটাতে ঘষটাতে এগোতে থাকে। ট্রেনটির যাত্রী, নৈহাটির অসীম সাউ বলেন, “মালগাড়ির চাপে আমাদের কামরা উল্টো দিকে হেলে যাচ্ছিল। ভয়ে দমবন্ধ হয়ে আসছিল। কিছুক্ষণ পরে দু’টো ট্রেনই দাঁড়িয়ে পড়ে।” এক যাত্রী জখম হয়েছেন। কোরাপুটের বাতানুকূল দুই কামরা ও ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুমড়ে যাওয়া বাতানুকূল কামরা দু’টি বাদ দিয়ে ট্রেনটি বুধবার সন্ধে ৭টা নাগাদ হাওড়ায় পৌঁছায়।
অন্য ঘটনাটি ঘটেছে এ দিন সকালে, উত্তর রেলের শ্রীনগরে। রেল-সূত্রের খবর: কাজিগুন্দ থেকে শ্রীনগরগামী যাত্রী-ট্রেনটি কাজিগুন্দের ঠিক আগের স্টেশন শাদুরাহের কাছে লাইনচ্যুত হয়। মন্ত্রকের বক্তব্য, ট্রেনটির শাদুরাহ স্টেশনে দাঁড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু চালক থামেননি। ব্রেক ঠিকমতো কাজ করেছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এক রেল-কর্তার কথায়, “দুর্ঘটনা রুখতে মূল লাইনের পাশে একটা লাইন থাকে। পয়েন্টও এমন ভাবে ‘সেট’ করা থাকে যে, স্টেশনে না-থামলে ট্রেন সোজা ওই লাইনে চলে যাবে।” এই ট্রেনও সোজা পাশের লাইনে গিয়ে স্যান্ড বাম্পে ধাক্কা মেরে থেমে যায়। ইঞ্জিন-সহ তিনটি কামরা বেলাইন হয়। আহত হন ৩০ জন যাত্রী।
চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে পর পর তিনটি দুর্ঘটনায় রেল-কর্তারা বিমূঢ়। তাঁদের বক্তব্য, প্রাথমিক তদন্তে শেষ দু’টো ঘটনায় চালকদের দিকে আঙুল উঠছে। উল্লেখ্য, দুন-দুর্ঘটনাতেও বাতানুকূল যন্ত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত অ্যাটেন্ড্যান্টের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
আর এর পরিপ্রেক্ষিতে রেল মন্ত্রকে এখন জল্পনা, কর্মীদের দক্ষতা কি তবে কমে যাচ্ছে? দীর্ঘ দিন নিয়োগ বন্ধ থাকায় এক জনকে দিয়ে বেশি কাজ করানোর ফলেই কি বাড়ছে দুর্ঘটনা? নাকি এ সব সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবেরই পরিণতি? |
রেল বোর্ডের অন্যতম এগ্জিউটিভ ডিরেক্টর (তথ্য ও প্রচার) চন্দ্রলেখা মুখোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, “কোরাপুট এক্সপ্রেসের চালক আট ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে ঝাড়সুগুদা স্টেশন থেকে ডিউটি শুরু করছিলেন। বাড়তি কাজ করানোর অভিযোগ এ ক্ষেত্রে খাটছে না।” যদিও রেলের চালকদের আক্ষেপ, টানা ডিউটি করতে করতে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন তাঁদের অনেকে। কর্তারাও স্বীকার করেছেন, রেলে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির দেড় লক্ষাধিক পদ ফাঁকা।
প্রশিক্ষণে গাফিলতি নিয়ে কী বলছেন তাঁরা? দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সৌমিত্র মজুমদারের দাবি, “ড্রাইভার, গাডর্র্, কেবিনম্যান-সহ ট্রেনচালনায় যুক্ত সকলকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রশিক্ষণ নিতে যেতে হয়। কোরাপুট এক্সপ্রেসের চালকও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।” তা হলে এমন হচ্ছে কেন? রেলের প্রাক্তন কর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুরের মতে, নিত্যনতুন প্রযুক্তি অনুযায়ী প্রশিক্ষণ-পদ্ধতিরও পরিবর্তন দরকার। বলেন, “সম্ভবত নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে কর্মীরা খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন না।”
সুভাষবাবুর অনুমান যে নিতান্ত অমূলক নয়, তার প্রমাণ রয়েছে। সম্প্রতি খড়্গপুর ডিভিশনে ‘রুট রিলে ইন্টারলক সিস্টেম কেবিন’-এ সমস্ত সিগন্যাল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রযুক্তি ঠিকঠাক জানা না-থাকায় ‘তালিমপ্রাপ্ত’ কর্মীরাও তা সারাতে পারেননি। প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা পরে প্রযুক্তি সরবরাহকারী সংস্থার কর্মীরা এসে তা ঠিক করতে সাহায্য করেন। |