‘উচ্ছেদ নয়, নিয়ন্ত্রণ’ নীতিতে দাঁড়িয়েই শহরের সৌন্দর্যায়নের লক্ষ্যে নতুন ‘হকার আইন’ আনতে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এই আইনে হকারেরা স্থায়ী দোকান গড়ে ব্যবসা করতে পারবেন না। জিনিসপত্র ফেরির ব্যবস্থা হবে ট্রলিতে। সুযোগ থাকলে সেই ট্রলিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে আয়ের ব্যবস্থা থাকবে। রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের দাবি, নতুন আইন হবে হকারদের অধিকার রক্ষা করেই। বাম আমলে যে ভাবে হকারদের বসার চারটি এলাকা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, এই আইনে সেই ধাঁচেই প্রতিটি পুরসভা এলাকার রাস্তাগুলি চার ভাগে ভাগ করে এক-এক জায়গায় এক-এক ভাবে হকারদের বসা নিয়ন্ত্রিত হবে। ফিরহাদ জানান, শহরের সৌন্দর্যায়নের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই হকার নিয়ন্ত্রণের কাজ হবে। সব ঠিকঠাক থাকলে কেন্দ্রের নির্দেশিকা মেনে তৈরি নয়া হকার আইনের বিলটি আগামী বিধানসভা অধিবেশনেই পেশ হতে পারে। |
কলকাতার সৌন্দর্যায়নে একই ধরনের আলো, একই রঙের বাড়ি এবং একই ধরনের হোর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করতে চান মুখ্যমন্ত্রী। সেই ধাঁচেই নতুন আইনে শহর-সহ রাজ্যের সব পুরসভা এলাকায় হকারদের স্থায়ী স্টলের বদলে নির্দিষ্ট ধরনের ট্রলির ব্যবস্থা করতে চায় প্রশাসন। এক-এক ধরনের হকারের জন্য হবে এক-এক রকম ট্রলি। যাঁরা জামাকাপড় ফেরি করেন, তাঁদের সকলের ট্রলির চেহারা এক রকম হবে। কিন্তু যাঁরা কাপড় বিক্রি করেন এবং যাঁদের খাবারের দোকান আছে, দু’দলের ট্রলি একই রকম হবে না। পুরমন্ত্রীর কথায়, “আইনে একই রকম ট্রলির ব্যবস্থা করার কথা বলা হচ্ছে। এ বার বিভিন্ন পুরসভা তাদের সুবিধে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট এলাকার ট্রলির চেহারা কী হবে, তা ঠিক করবে।”
তবে, এর সঙ্গেই নতুন আইনে হকারদের বসার সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। ২০০৯ সালে বামফ্রন্ট সরকারের হকার-নীতির ধাঁচে প্রতিটি পুরসভার রাস্তাগুলি ভাগ করা হবে রেড, ইয়েলো, ব্লু এবং গ্রিন জোনে। রেড জোনে কোনও সময়েই হকার বসতে পারবে না। গ্রিন জোনে ২৪ ঘণ্টাই হকারেরা বসতে পারবেন। কিন্তু ইয়েলো এবং ব্লু জোনে বসা যাবে দিনে বা রাতে। সে ক্ষেত্রে ট্রলিগুলি বাকি সময়ে কি ফুটপাথ জুড়েই থাকবে? পুরমন্ত্রীর বক্তব্য, “ইয়েলো এবং ব্লু জোনের জন্য সংশ্লিষ্ট পুরসভা এলাকায় পার্কিং এলাকা তৈরি করা হবে। ফেরি করার সময়সীমা শেষ হলে পার্কিং এলাকায় গিয়ে ট্রলি রেখে আসতে হবে। কোথায় পার্কিং এলাকা হবে, তা পুরসভাগুলিই ঠিক করবে।”
এখানেই অবশ্য শেষ নয়। যে সব পুর-এলাকায় সুযোগ আছে, সেখানে ট্রলিতে বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যবস্থাও করতে চায় রাজ্য। ফিরহাদের কথায়, “বিভিন্ন সংস্থাকে হকারদের ট্রলি তৈরি করে দিতে বলা হবে। বিনিময়ে ট্রলিতে বিজ্ঞাপন দিতে পারবে ওই সব সংস্থা। যে সব পুর-এলাকায় এই ব্যবস্থা করা যাবে না, সেখানে হকারেরাই ট্রলি কিনবেন। পুরসভা তাতে ভর্তুকি দেবে।” রাজ্য সরকারের এই বিপণনের ভাবনাকে স্বাগত জানাচ্ছেন বিপণন বিশেষজ্ঞ শিলু চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “এই মুহূর্তে বিভিন্ন সংস্থা টিভির চেয়ে হোর্ডিং বা দোকানে-দোকানে বিজ্ঞাপন দেওয়া বেশি পছন্দ করছে। সে ক্ষেত্রে হকারদের ট্রলিতে বিজ্ঞাপন দেওয়ার সুযোগ তাদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট লাভজনক। তা ছাড়া, কোনও সংস্থা যদি শুধু গড়িয়াহাটে তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতে চায়, সে ক্ষেত্রে হকারদের ট্রলি তাদের কাছে সব চেয়ে বড় উপায় হয়ে উঠবে।” তবে একই সঙ্গে শিলুবাবু আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ট্রলিগুলির আকৃতি নিয়ে। তাঁর কথায়, “বড় সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। তারা ঠিকঠাক ট্রলি তৈরি করে দেবে। কিন্তু ছোট সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে তা নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে ট্রলির চেহারা কী হবে, তার খুঁটিনাটি নির্ধারণ করতে হবে পুরসভাকেই। না হলে পুরো ভাবনাটাই বানচাল হয়ে যাবে।”
রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর সূত্রে খবর, নয়া আইনে রাজ্যের কোনও হকারই আর ফুটপাথের উপরে স্থায়ী কাঠামো গড়ে ব্যবসা করতে পারবেন না। সব হকারকেই ট্রলিতে ফেরি করতে হবে। পুরমন্ত্রীর কথায়, “স্থায়ী কাঠামো ভেঙে ফেলে ট্রলি ব্যবস্থায় ফিরতে হবে। না হলে তাঁদের হকার লাইসেন্সই দেওয়া হবে না।” |